হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায়
![]() |
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে উনিশ শতকের বাংলার কী ধরনের সমাজচিত্র পাওয়া যায়? |
ভূমিকা
যেসব সংবাদপত্র থেকে উনিশ শতকের বাংলাসমাজের প্রতিফলন পাওয়া যায় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে সামাজিক শোষণ, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায়।
প্রকাশকাল ও প্রকাশক
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি কলকাতার জনৈক ব্যাংকার মধুসূদন রায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ করেন। তখন গিরীশচন্দ্র ঘোষ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি প্রথমে ইংরেজি সাপ্তাহিক ছিল, পরে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ তা দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়।
সামাজিক প্রতিফলন
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সমাজজীবনে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘটনার প্রতিফলন দেখা যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়।
উদীয়মান মধ্যবিত্তশ্রেণির চরিত্র, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে এই পত্রিকায়। পত্রিকাটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হত এবং পত্রিকার পাঠকরা ইংরেজি-শিক্ষিত ছিলেন- যা সমাজের একটি আলোকিত গোষ্ঠীর (elite) অস্তিত্বের পরিচয় দেয়।
পত্রিকাটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র ছিল। জমিদার শ্রেণির এই সমিতিটি সর্বদাই মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট ছিল।
অর্থনৈতিক প্রতিফলন
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, রাজস্বের চড়া হার, জমিদারি শোষণ ও অত্যাচার, কৃষিজীবীদের অভাব-অভিযোগ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
রাজনৈতিক প্রতিফলন
[1] আন্দোলনে সমর্থন: এই পত্রিকার মাধ্যমে ভারতবাসীর রাজনৈতিক মতামত প্রতিফলিত হয়। যথা- এই পত্রিকা প্রকাশের কিছুদিন পরেই সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে (১৮৫৫ খ্রি.)। বিদ্রোহের খবর এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। এর অল্পকাল পর সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) ঘটে। এই বিষয়ে পত্রিকায় বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তারপর বাংলায় নীলচাষিদের আন্দোলন দেখা দেয়। তখন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর চেষ্টায় নীলচাষিদের আন্দোলনের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকা এই ঘটনাগুলিকে সমর্থন জানায়।
[2] সরকারি নীতির বিরোধিতা ও সমর্থন: এই পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসী সরকারি নীতির বিরোধিতা করে। বড়োলাট লর্ড লিটন ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক। তিনি সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার জন্য ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act) জারি করেন। এর দ্বারা সরকারি নীতির সমালোচক, দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও ছাপাখানার মালিকের কারাবাসের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর প্রতিবাদ জানায়।
সরকার ইমিগ্রেশন বিল পাস করে আসামের চা-বাগানে বিহার থেকে শ্রমিক সরবরাহের ব্যবস্থা করে। পত্রিকা এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। উদারবাদী বড়োলাট লর্ড রিপন বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করার জন্য ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইলবার্ট বিল তৈরি করেন। এর প্রতিবাদে ইংরেজরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা বিলকে সমর্থন জানিয়ে পালটা আন্দোলন করে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা জাতীয়তাবাদী মতকে সমর্থন জানায়।
সীমাবদ্ধতা
তবে এই পত্রিকাটির কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। যেমন- বাংলার নারীসমাজের কথা পত্রিকায় থাকত না। পত্রিকা বাংলার বৃহত্তর সমাজের কাছে পৌঁছোতে পারেনি, একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। জনগণের মধ্যে শিক্ষার অভাব, কুসংস্কারের প্রভাব ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ নীরব ছিল।
মূল্যায়ন
ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও এ কথা বলতে হয়, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকা বাংলায় ইংরেজি-শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করত। পত্রিকাটি জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে। এ ছাড়া, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহের কাহিনি প্রচার করে ভারতীয়দের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।
নীলদর্পণ’ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্রের বর্ণনা দাও।
![]() |
নীলদর্পণ’ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্রের বর্ণনা দাও। |
ভূমিকা:
সাময়িক পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থের মতো নাটক থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নাটকটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলার কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে এই নাটকটি রচিত।
বিষয়বস্তু:
কৃষকদের অভাব, দারিদ্র্য, নীলকরদের শোষণ-অত্যাচার, জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের দমনমূলক ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষকদের প্রতিরোধ, সংগ্রাম-এইসব নিয়ে তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন নীলদর্পণ নাটকে ফুটে উঠেছে। আর্থসামাজিক পটভূমিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা সাম্প্রদায়িকতার উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। আবার ইংরেজ আনুগত্য দূর করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি নীলচাষিদের সমর্থনে যেভাবে এগিয়ে এসেছিল নাটকটিতে তাও সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
উদ্দেশ্য:
এই নাটক রচনার উদ্দেশ্য ছিল-
1। ইংরেজদের শোষণ-অত্যাচার বন্ধ করা।
[2] কৃষকদের মঙ্গলসাধন করা।
3। মাটির মানুষের কাছাকাছি পৌঁছোনো ইত্যাদি।
নীলচাষিদের দুর্দশা :
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা ছিল চাষবাস। ধান বা খাদ্যশস্য চাষ ছিল এর মধ্যে প্রধান।
1 ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের প্রচুর চাহিদা ছিল। সেজন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংরেজ খামার মালিকেরা দলে দলে ভারতে আসতে থাকে। এ ছাড়া ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে ইউরোপীয়দের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তারা বেশি লাভের আশায় এলাকা চাষের বদলে বে-এলাকা চাষে আগ্রহী হয়।
[2] চাষিদের বিঘা প্রতি ২ টাকা দাদন দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত তারা। চাষিরা অসম্মত হলে নীলকররা চাষির গোরুবাছুর কেড়ে নিত, চাষির বাড়ি ভেঙে দিত, তাদের পরিবারের লোকজনকে মারধর করত।
[3] পঞ্চম রেগুলেশন আইন থাকা সত্ত্বেও চাষিরা নীলচাষ করতে বাধ্য হত। নীলের তুলনায় ধান বা তামাক চাষ বেশি লাভজনক ছিল। কিন্তু চাষিরা তা চাষ করতে পারত না। ফলে তারা খাদ্যাভাব ও ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়ত।
চাষিদের প্রতিরোধ:
নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচার নীলচাষিরা নীরবে মেনে নেয়নি। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীলচাষিরা প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। নাটকে নীলচাষি তোরাপের ভূমিকাতে তা স্পষ্ট। বাংলার হিন্দু-মুসলিম নীলচাষিদের ঐক্যবদ্ধ এই সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল।
শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির ভূমিকা :
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে নীলচাষিদের আন্দোলন শুরু হয়। এর মাত্র ২ বছর আগে সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) ঘটে। বাংলাদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করে। কিন্তু নীলচাষিদের আন্দোলনে তারা সহানুভূতি ও সমর্থন জানায়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা, শিশিরকুমার ঘোষের অমৃতবাজার পত্রিকা, আলোচ্য নীলদর্পণ নাটক নীলচাষিদের দুঃখদুর্দশা ও নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি প্রচার করে। এর ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজ শাসন ও নীলকরদের শোষণের স্বরূপ বুঝতে পারে। তখন তারা নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। এই নাটকের অন্তর্গত গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ত্রী ও সাবিত্রী প্রভৃতি চরিত্রগুলি ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ।
মূল্যায়ন:
উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ছিল নীলদর্পণ নাটক। পাশ্চাত্য ধারায় প্রভাবিত পঞ্চাঙ্ক নাটকের চরিত্রগুলি সংস্কৃত নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলার অসহায় নীলচাষিদের লাঞ্ছনার মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে নাটকটিকে ঐতিহাসিক বলা যায়। সমকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের খণ্ডচিত্র নাটকটির মধ্যে ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা