স্বাভাবিক অধিকার’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো

স্বাভাবিক অধিকার' সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।
স্বাভাবিক অধিকার’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।

স্বাভাবিক অধিকার

স্বাভাবিক অধিকার বলতে এমন সব অধিকারকে বোঝায় যা রাষ্ট্র দ্বারা অনুমোদিত নয় বা যেসব অধিকারের সৃষ্টিকর্তা রাষ্ট্র নয় বা যেসব অধিকার লাভের জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের কোনোরূপ প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিক অধিকারসমূহ মানুষের জন্মগত এবং সহজাত। এই অধিকার কখনো স্থান, অবস্থা প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়। 

[1] বিকাশলাভ: 

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগণ এবং পরবর্তীকালের চুক্তিতত্বের প্রবত্তাগণ, যেমন- হবক্স, লক, রুশো প্রমুখ দার্শনিকদের চিন্তাধারা ও রচনায় স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বটি বিকাশ লাভ করে।

[2] লকের বক্তব্য: 

দার্শনিক লক দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রসৃষ্টির আগে ও পরে স্বাভাবিক অধিকার’ বিষয়টি অদ্ভুজা অবস্থাতেই বিদ্যমান স্বাভাবিক অধিকারকে কখনো সংকুচিত করা বা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষ ‘প্রাকৃতিক অবস্থায়’ যেসব স্বাভাবিক অধিকার ভোগ করত, চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনের সময় সেইসব অধিকারের কিছু অংশ রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয় এবং সেই অংশগুলিকে সংরক্ষণ করে রাষ্ট্র। এ ছাড়াও কিছু অংশ থেকে যায় ব্যক্তির হাতে। ‘স্বাভাবিক অধিকার’ (Natural Rights) বলতে লক মূলত তিনটি বিষয়কে বুঝিয়েছেন, যথা- (a) জীবনের অধিকার, [b] স্বাধীনতার অধিকার এবং [c] সম্পত্তির অধিকার।

[3] টি. এইচ. প্রিন-এর বক্তব্য:

টি. এইচ, জিন স্বাভাবিক অধিকার বলতে সেইসব অধিকারকে বুঝিয়েছেন, যার মাধ্যমে মানুষ নৈতিকতার বিষয়টি অনুভব করে। রাষ্ট্র বাস্তিকে তার অধিকার দানের সময় নৈতিক অধিকারটির দিকে লক্ষ রাখে কারণ নৈতিক সত্তা ব্যতিরেকে কোনো অধিকার আইনের মর্যাদা লাভ করতে পারে না।

[4] ফরাসি দার্শনিক রুশোর বক্তব্য:

ফরাসি দার্শনিক রুশো ‘স্বাভাবিক অধিকার’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, স্বাভাবিক অধিকারগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দ্বারা শৃঙ্খলিত নয়। ‘সামাজিক চুক্তি’তে এক আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন যে, ‘সাধারণ ইচ্ছা’, বা ‘General Will’-ই হল স্বাভাবিক অধিকারের আধার। এই ‘সাধারণ ইচ্ছা’ বা ‘General Will’ দ্বারা মানুষের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি সংরক্ষিত হয়।

[5] ঐতিহাসিক ঘটনা: 

‘স্বাভাবিক অধিকার’-এর ধারণাটি কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেও সন্নিবিষ্ট। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজার নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এবং সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যে লড়াই সংঘটিত হয়েছিল, স্বাভাবিক অধিকারের ধারণাটির মূল বিষয়সমূহ তার ভিতরেই নিহিত ছিল। এক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যথা- [a] 1776 খ্রিস্টাব্দের 4 জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ‘the Declaration of Independence’ ঘোষিত হয়েছিল তাতে মানুষকে ‘equal’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। [b] ফ্রান্সে রাজতন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিকতার অবসান এবং বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক ঐতিহাসিক পষ্টপরিবর্তন ঘটে যায়। এই সময় (1789) জাতীয় পরিষদ যে, ‘Declaration of the Rights of Man and Citizen’ ঘোষণা করেছিল, সেখানে স্বাভাবিক অধিকারের কথাও ঘোষিত হয়। সমগ্র পৃথিবীতে এই অধিকারের স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিব্যাপ্তি ঘটে।

সমালোচনা

‘স্বাভাবিক অধিকার’-এর তত্ত্বটিকে একেবারে ত্রুটিমুক্ত বলা যায় না। এই কারণে এই তত্ত্বটি বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-

[1] অধিকার পরিবর্তনশীল; 

সমালোচকরা মনে করেন, সমাজ পরিবর্তনশীল এবং অধিকার সেই পরিবর্তনশীল সমাজের উপরেই নির্ভর করে আছে। সমাজের বাইরে অধিকারকে চিন্তা করা যায় না সমাজের পরিবর্তন ঘটলে অধিকারেরও পরিবর্তন ঘটবে। এই কারণে স্বাভাবিক অধিকারকে তাঁরা সহজাত এবং শাশ্বত বলে উল্লেখ করেননি।

[2] স্বাভাবিক অধিকার অবাধ নয়: 

সমালোচকদের মতে, স্বাভাবিক অধিকার অবাধ হতে পারে না। অবাধ অধিকার স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্নয় করে দাঁড়িয়ে থাকে। এর ফলে দেখা দেয় নিয়ন্ত্রণবিহীন এক ‘মাৎস্যন্যায়’ ব্যবস্থা। তাই রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রণমুক্ত কোনো অধিকার থাকতে পারে না।

উপসংহার: 

উপসংহারে একথা বলা যায় যে, যেসব অধিকার মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক, স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের প্রবক্তাগণ সেইসব বিষয় তুলে ধরে বা বাস্ত করে অধিকার সম্পর্কে ব্যক্তিকে সচেতন করে তুলেছেন, এর কোনো তুলনা হয় না।

Leave a Comment