সাম্য ও স্বাধীনতা কীভাবে পরস্পর সম্পর্কিত তা আলোচনা করো

সাম্য ও স্বাধীনতা কীভাবে পরস্পর সম্পর্কিত তা আলোচনা করো।
সাম্য ও স্বাধীনতা কীভাবে পরস্পর সম্পর্কিত তা আলোচনা করো।

সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক

আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হল সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ। তবে সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। যাঁরা সাম্যকে স্বাধীনতার বিরোধী বলে মনে করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন তকডিল, লর্ড অ্যাক্টন প্রমুখ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাবিদগণ। তাঁরা মনে করেন- প্রথমত, সাম্যের ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করলে স্বাধীনতা বিলীন হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে। ব্যক্তির ক্রিয়াকার্য আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, এর ফলে স্বাধীনতার ধারণাটি বাধাপ্রাপ্ত হবে।
অধ্যাপক ল্যাঙ্কি অবশ্য এইসব বক্তব্যকে সমর্থন করেননি। তিনি সামাকে স্বাধীনতার বিরোধী বলে মনে করেননি। ল্যাভি মনে করেন, বাক্তির ব্যক্তিত্ববিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন। এই পরিবেশের জন্য সকলকেই সাম্য ও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টিকে নজরে রাখতে হবে।
ফরাসি দার্শনিক রুশো সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো বিরোধ দেখেননি। জন স্টুয়ার্ট মিল মনে করতেন, সাম্য। ও স্বাধীনতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং তা একে অপরের পরিপূরক। স্বাধীনতার বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক সাম্যের প্রয়োজন আছে। উনি (R H Tawney) মনে করেন যে, সাম্য স্বাধীনতার বিরোধী তো নয়ই, বরং স্বাধীনতা বজায় রাখতে গেলে অধিক পরিমাণে সাম্যের প্রয়োজন। স্বাধীনতাকে যদি মানবিক সত্তার বিকাশস্থল ধরা হয়, তাহলে তা একমাত্র সম্ভব হবে সাম্যবাদী সমাজে, সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া স্বাধীনতার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।
সাম্যহীন স্বাধীনতা হতে পারে না। সাম্যহীন স্বাধীনতা স্বাধীনতার একটি প্রহসন মাত্র। সামা ক্ষমতার বৈষম্য, সামাজিক সম্পদের বৈষম্য, আইনের বৈষম্য প্রভৃতিকে দূর করে মানুষের স্বাধীনতাকে বিকশিত হওয়ার পথ করে দেয়। স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে, ব্যক্তি লাড করে বস্তুগত স্বাধীনতা ও বৌখিক নিরাপত্তা।
‘আইনের দৃষ্টিতে সাম্য’ কথাটি সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট-এক্ষেয়ে আইন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না-তা সকলের। রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেয়েও অনুরূপ কথা প্রযোজ্য। কোনো শাসকগোষ্ঠীর সামান্য কিছু এলিট যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে, তবে সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য সংকটাপন্ন হবে। একইভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যদি সমাজে মুষ্টিমেয় মানুষ ধনসম্পদের অধিকারী হয় এবং এর সুযোগসুবিধা লাভ করে, তাহলে আপামর মানুষ বিপদগ্রস্ত হবে। এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হল সাম্যপ্রতিষ্ঠা। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য থাকে না। প্রভু ভুতোর বিরোধের অবসান ঘটে।
মার্কসবাদী লেখকগণও সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্কের কথা বলেছেন। তাঁরা সাম্যকে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বলে মনে করেন। যতদিন সমাজে শ্রেণিবিভাজন থাকবে, ততদিন স্বাধীনতাও বাধাপ্রাপ্ত হবে। সামাজিক অসাম্যের মধ্যে স্বাধীনতার বিকাশ ঘটে না। মাকসবাদীদের মতে, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে ‘ধনতান্ত্রিক আস্ফালন’ বিলুপ্ত হবে এবং শ্রেণিবিরোধের অবসান ঘটবে। জাপ সমাজেই স্বাধীনতার যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব হবে। সুতরাং বলা যায় যে, সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা থাকতে পারে না অথবা, বলা যায় সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।

Leave a Comment