শিল্পস্থাপনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

শিল্পস্থাপনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
শিল্পস্থাপনের কারণগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

যান্ত্রিক পদ্ধতি ও কর্মনিপুণতার সাহায্যে কাঁচামালকে অধিক কার্যকর ও মূল্যবান ভোগ্যপণ্যে পরিণত করাকে শিল্প বলে। কোনো স্থানে শিল্পস্থাপন ও উন্নয়ন একাধিক কারণের ওপর নির্ভর করে। এই কারণগুলি মূলত তিনপ্রকার A প্রাকৃতিক কারণ, B অর্থনৈতিক কারণ ও C রাজনৈতিক কারণ।

A প্রাকৃতিক কারণ :

কাঁচামাল :

কোনো শিল্পব্যবস্থায় যেসব উপাদানের ওপর নির্ভর করে উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাদের কাঁচামাল বলে। কাঁচামালের প্রকৃতি, সহজলভ্যতা প্রভৃতি শিল্পস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। যেমন- লৌহ-ইস্পাত শিল্প। (ⅰ) বিশুদ্ধ কাঁচামাল : শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওজনের তুলনায় উৎপন্ন দ্রব্যের ওজন সমান হলে বা বেশি হলে সেইসব কাঁচামালকে বিশুদ্ধ বা ওজন হ্রাসহীন কাঁচামাল বলে। এই ধরনের শিল্প কাঁচামাল নির্ভর না হয়ে দূরবর্তী কোনো স্থানেও গড়ে উঠতে পারে। যেমন- কার্পাস বয়ন শিল্প। (ii) অবিশুদ্ধ কাঁচামাল : শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওজনের তুলনায় উৎপন্ন দ্রব্যের ওজন কম হলে সেই কাঁচামালকে অবিশুদ্ধ কাঁচামাল বলে। এ ধরনের কাঁচামাল নির্ভর শিল্পসমূহ কাঁচামাল উৎপাদক অঞ্চলের কাছেই গড়ে ওঠে। যেমন- লৌহ-ইস্পাত শিল্প। এ ছাড়া, (iii) কাঁচামাল পচনশীল বা ভঙ্গুর হলে শিল্প কাঁচামালের প্রাপ্তিস্থানেই গড়ে ওঠে। যেমন মৎস্যশিল্প, কাচশিল্প প্রভৃতি। (iv) কোনো শিল্পে একাধিক কাঁচামাল ব্যবহৃত হলে যে কাঁচামালটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হয়, সেই কাঁচামালকে কেন্দ্র করে ওই শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন- লৌহ-ইস্পাত শিল্প। 

জল: 

শিল্প স্থাপনের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জল। কেবল শিল্পকারখানা নয়, শিল্প শ্রমিকদের জন্য প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়। তাই জলের অবস্থান ও সহজপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন- দুর্গাপুর লৌহ-ইস্পাত শিল্প দামোদর নদের তীরে গড়ে উঠেছে। সুবর্ণরেখা ও খরকাই নদীর সঙ্গমে জামশেদপুর শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। 

বিদ্যুৎ : 

শিল্প গড়ে তুলতে এবং চালু রাখতে বিদ্যুৎ একটি অপরিহার্য উপাদান। তাপবিদ্যুতের অন্যতম প্রধান উৎস হল কয়লা ও খনিজ তেল। এ ছাড়া রয়েছে জলবিদ্যুৎ। এই দুই বিদ্যুৎ যেখানে সহজপ্রাপ্য সেখানে শিল্পের বিকাশ সম্ভব। তবে বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎশক্তিও শিল্পস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছে। যেমন হীরাকুঁদ জলবিদ্যুৎ ও রৌরকেলা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে নির্ভর করে রৌরকেলা ইস্পাত শিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দামোদর উপত্যকা প্রকল্পের বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে দুর্গাপুর, বার্নপুর-কুলটি প্রভৃতি ইস্পাত শিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

B অর্থনৈতিক কারণ :

শ্রমিক : 

সুলভ ও দক্ষ শ্রমিকের সহজলভ্যতা শিল্পস্থাপনের অন্যতম ভিত্তি। কারণ- শ্রমিকের কর্মদক্ষতার ওপরই শিল্পজাত পণ্যের গুণমান নির্ভর করে। এ ছাড়া শিল্পকে লাভজনক করার জন্য শ্রমিকের মজুরির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই যেখানে সস্তায় দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায় সেখানে শিল্পস্থাপন লাভজনক। 

পরিবহণ : 

শিল্পকেন্দ্রে কাঁচামাল আনা এবং শিল্পজাত দ্রব্য শিল্পকেন্দ্র থেকে বাজারে পাঠানোর জন্য উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন। এ কারণে উন্নত রেল পরিবহণ, সড়ক পরিবহণ, জল পরিবহণ বা আকাশ পরিবহণযুক্ত স্থান শিল্প গড়ে ওঠার পক্ষে আদর্শ। 

বাজার : 

কোনো শিল্পস্থাপন তখনই লাভজনক হবে যখন সেই শিল্পজাত দ্রব্যের দেশ বিদেশে বিপুল চাহিদা ও বিশাল বাজার থাকবে। অনেক শিল্প আছে যেগুলি বাজারের নিকট গড়ে ওঠাই অত্যন্ত লাভজনক। যেমন – কার্পাস বয়ন শিল্প, রেশম শিল্প, দুগ্ধজাত শিল্প, ইলেকট্রনিকস শিল্প, গয়না শিল্প প্রভৃতি। 

মূলধন 

যে-কোনো শিল্পস্থাপনের জন্য প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন। জমি কেনা, কারখানা তৈরি, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি কেনা, বিদ্যুৎ খরচ, শ্রমিকের মজুরি, বিপণন ব্যবস্থা প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই মূলধন অতি আবশ্যক। যেমন- ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে পার্শি, গুজরাটি প্রভৃতি ব্যবসায়ীদের প্রচুর মূলধন বিনিয়োগে কার্পাস বয়ন শিল্পের উন্নতি সম্ভব হয়েছে। 

উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা : 

আধুনিক শিল্পব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ অতি আবশ্যক। এর ফলে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাবে, চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন খরচ কম হবে এবং শিল্পের ক্রমোন্নতি ঘটবে।

C রাজনৈতিক কারণ :

সরকারি নীতি: 

সরকারি নীতি পরিকল্পনা শিল্পস্থাপনে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সরকারের শুল্কনীতি, লাইসেন্স নীতি, জমি নীতি, বাণিজ্য নীতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় শিল্পের ওপর প্রভাব ফেলে। 

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : 

কোনো স্থানের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি শিল্পের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শিল্পস্থাপনের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কেরালা প্রভৃতি রাজ্য শিল্পক্ষেত্রে ক্রমশ উন্নতি করছে।

Leave a Comment