মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সুবিধা ও অসুবিধা বিষয়ে দুই বন্ধুর কাল্পনিক সংলাপ |
রতন: মাতৃভাষার আধারেই আমাদের মননজাত যাবতীয় চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটে। মাতৃভাষায় বাক্যালাপের যে তৃপ্তি তা তো ভাবনাতীত। তাহলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্পূর্ণ রূপে শিক্ষাদান সম্ভব নয় কেন?
তপন: এ কথা ঠিক যে, শিক্ষাদান বা গ্রহণের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার অবদান অনস্বীকার্য। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে যে সারল্য ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হয় তা ভাষায় প্রকাশের অতীত। তবে এ কথাও ঠিক সব বিষয়ের পড়াশোনা কিন্তু মাতৃভাষায় সম্ভব নয়।
রতন: কেন সম্ভব নয়?
তপন: কারণ, দেশে-বিদেশে বিশেষত বিজ্ঞানচর্চা কিন্তু ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। আমাদের দেশেও একদিকে যেমন দেখা যায়, সহজ-সরল বাংলায় বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে উপস্থাপন করার আগ্রহ কেউ দেখায় না, তেমনি আবার অনেকে এও মনে করেন যে বিজ্ঞানের গুরুগম্ভীর বিষয়কে প্রকাশ করার জন্য বাংলা ভাষা উপযুক্ত নয়।
রতন: এসব মোটেও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি হল না। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মহামনীষীরা মাতৃভাষাতেই সাফল্যের সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা করেছেন।
তপন: সে ঠিক, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবেও তো মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা গ্রহণযোগ্য নয়।
রতন: ইংরেজরা একসময় নিজেদের স্বার্থে কিছু বেতনভুক কেরানি তৈরির জন্য ইংরেজি ভাষার প্রবর্তন করেন। তা যদি না হত তাহলে কি আমরা উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে বা বিজ্ঞানচর্চায় ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের কথা ভাবতাম? আমাদের একমাত্র অবলম্বন হত মাতৃভাষা। তা ছাড়া শিক্ষণীয় বিষয় ও শিক্ষার্থীর মাঝের ব্যবধানকে একমাত্র মুছে দিতে পারে মাতৃভাষাই।
তপন: বিদেশি ভাষার প্রতি অন্ধ আনুগত্য আমারও নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, উচ্চতর শিক্ষালাভে বা কর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রদানে মাতৃভাষা ব্যবহৃত হয় না। তা ছাড়া বর্তমান বস্তুবিশ্বে প্রতিটি কর্মস্থলে বিদেশি ভাষা, বিশেষত ইংরেজি ভাষার প্রতি বিশেষ দখলের ওপর নজর দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী না হওয়ায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি লাভে বঞ্চিত হয়, এক্ষেত্রে আজীবন মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করেও মানুষ চরম ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়।
রতন: জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে কিন্তু শিক্ষাদান বা কর্মস্থল প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাতৃভাষাই মূল অবলম্বন।
তপন: আমাদের দেশ বহুভাষী দেশ। প্রায় ১২২টির মতো ভাষা এ দেশে প্রচলিত রয়েছে। সেক্ষেত্রে যদি প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা ভাবে, তাহলে সেক্ষেত্রে জাতীয় স্তরের শিক্ষাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানগুলিতেই অংশগ্রহণের সামর্থ্য কারও থাকবে না, আন্তর্জাতিক স্তরের প্রসঙ্গ নয় বাদই দেওয়া গেল। একটি তো একক ভাষা থাকা দরকার, যা ভারতের প্রতিটি রাজ্যের মানুষই কমবেশি জানবে। জাতীয় সম্মেলন তথা জাতীয় স্তরের সরকারি কার্যকলাপের স্বার্থেও মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা প্রয়োজন।
রতন: ঠিক আছে মেনে নিলাম সব যুক্তি। তবুও আমাদের জাতীয়তাবোধ, স্বাধীন চেতনা ও স্বদেশ ভাবনাকে জাগ্রত রাখার জন্যও মাতৃভাষার চর্চাকে অব্যাহত রাখতে হবে। প্রযুক্তির যুগেও দেশীয় সাহিত্যকে মর্যাদা দানের জন্য মাতৃভাষা চর্চা বন্ধ করলে চলবে না।