ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? ব্যঞ্জনধ্বনি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর |
১। ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে?
উত্তর যেসব ধ্বনি উচ্চারণকালে শ্বাসবায়ু ফুসফুস থেকে প্রবাহিত হতে গিয়ে স্বরপথে, মুখবিবরে বা বাগ্যন্ত্রের কোথাও বাধা পায় বা ধাক্কা খায় এবং স্বরযন্ত্রের ঊর্ধ্বস্থ বাগ্যন্ত্রকে কাঁপিয়ে দেয় তাদের ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।
২। উচ্চারণের দিক দিয়ে ব্যঞ্জনবর্ণকে কটি ভাগে ভাগ করা যায় ও কী কী?
উত্তর উচ্চারণের দিক দিয়ে ব্যঞ্জনবর্ণকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা- উচ্চারণস্থান অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ। উচ্চারণের প্রকার অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ। বায়ুপ্রবাহের পদ্ধতিগত দিক থেকে শ্রেণিবিভাগ।
৩। উচ্চারণস্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির ভাগগুলি কী কী?
উত্তর উচ্চারণের স্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির ভাগগুলি হল-ক কণ্ঠ্যব্যঞ্জনধ্বনি, তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনি, মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনি, য দন্ত্যব্যঞ্জনধ্বনি, ও দন্ত্যমূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনি, ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি, দন্তৌষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি এবং জি কণ্ঠ্যনালীয় ব্যঞ্জনধ্বনি।
৪। কণ্ঠ্যব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের পশ্চাদভাগ তালুর কোমল অংশ স্পর্শ করে, তাকে কণ্ঠ্যব্যঞ্জনধ্বনি বলে। কণ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি পাঁচটি। যেমন-ক্, খ, গ, ঘ, ঙ, হ্।
৫। তালব্যব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভ প্রসারিত হয়ে শক্ত তালু স্পর্শ করে, তাদের তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন—চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, শ, য, য।
৬। মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের প্রসারিত অগ্রভাগ উলটে গিয়ে মূর্ধাকে স্পর্শ করে, তাকে মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-ট্, ট্, ড্, ঢ, ণ, র্, য্ ইত্যাদি মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনি।
৭। দন্ত্যব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের অগ্রভাগ দন্তপত্তির পশ্চাতে জুড়ে যায়, তাকে দন্ত্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-ত্, থ, দ, ধ, ন,ল্, স্।
৮। দন্ত্যমূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর প্রকৃতপক্ষে এটি দন্ত্যব্যঞ্জনেরই প্রকারভেদ। যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের অগ্রভাগ দন্তপত্তির মূলকে স্পর্শ করে, তাকে দন্ত্যমূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-নৃ ও স্।
৯। ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে ধ্বনিবাহী বায়ু ওষ্ঠ ও অধরের বন্ধ বা খোলার জন্য বাধা পায়, তাকে ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-প্, ফ, ব, ভ, ম্।
১০। দন্তৌষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে ওষ্ঠ দন্ত নীচের দন্তপত্তি স্পর্শ করে, তাকে দন্তৌষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়। এটি ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনেরই বিশেষ প্রকার। বাংলায় একটিমাত্র দন্তৌষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি আছে। যেমন-অন্তঃস্থ ‘ব’।
১১। কণ্ঠ্যনালীয় ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় কণ্ঠনালির পেশি সংকুচিত হয়ে ধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাকে কণ্ঠ্যনালীয় ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন—‘ছ’ ও ” কণ্ঠ্যনালীয় ব্যঞ্জনধ্বনি।
১২। উচ্চারণের প্রকার অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির ভাগগুলি কী কী?
উত্তরা উচ্চারণের প্রকার অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির ভাগগুলি হল- ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি, এ অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি।
১৩। ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর প্রতি বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ধ্বনির উচ্চারণে স্বরতন্ত্রীর কম্পনে কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয় বলে, এদের ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-গ, ঘ, ঙ্, জ, ঝ, ঞ, ড, ঢ, ণ, দ, ধ, ন, ব, ভ, ম্-এগুলি ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি। ড. পবিত্র সরকার বলেছেন, র্, ড়, ঢ়, ই এগুলিও ঘোষ বা সঘোষ বা ঘোষবৎ ব্যঞ্জনধ্বনি। গাম্ভীর্যসম্পন্ন ধ্বনিই ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি বা নাদধ্বনি।
১৪ | ঘোষীভবন কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর উচ্চারণের জন্য অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনিতে রূপান্তরিত হলে, তাকে ঘোষীভবন বলেন। যেমন-কাক > কাগ, ধপধপে > ধবধবে, শাক > শাগ ইত্যাদি।
১৫ । অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর প্রতি বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণের উচ্চারণে স্বরতন্ত্রীর কম্পন অতি মৃদু হওয়ায় ঘোষ বা নাদ থাকে না, তাই এদের অঘোষব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-ক্, খ, চ, ছ,ট্, ই, ত, থ, প, ফ্। একে শ্বাসবর্ণও বলা হয়।
১৬। অঘোষীভবন কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর উচ্চারণের জন্য ঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনি অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনিতে রূপান্তরিত হলে, তাকে অঘোষীভবন বলে। যেমন-কাগজ > কাগচ, বাবু > বাপু, বড়ঠাকুর > বঠাকুর ইত্যাদি।
১৭। বায়ুপ্রবাহের পদ্ধতিগত দিক অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির ভাগগুলি কী কী?
উত্তর বায়ুপ্রবাহের পদ্ধতিগত দিক অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির ভাগগুলি হল- অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি, ⑦ খৃষ্ট ব্যঞ্জনধ্বনি, মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি, নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি, ও উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি, ⑤ কম্পিত ব্যঞ্জনধ্বনি, পার্শ্বিক ব্যঞ্জনধ্বনি, তাড়নজাত ব্যঞ্জনধ্বনি, রণিত ব্যঞ্জনধ্বনি, এ অন্তঃস্থ ব্যঞ্জনধ্বনি এবং ট আশ্রয়ভাগী ব্যঞ্জনধ্বনি।
১৮। অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর ‘প্রাণ’ শব্দের অর্থ হল শ্বাসবায়ু। প্রতি বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনি উচ্চারণকালে প্রাণ বা শ্বাসবায়ু কম প্রয়োজন হয়। তাই এদের অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-ক্, গ, চ্, জ্, ট্, ড্, ত্, দ, প্, ব্। অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির সঙ্গে ‘হ’ যুক্ত করে একত্র উচ্চারণ করলে মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনির মতো শোনায়। যেমন-ক্ + ই = খ, গ্ + ই = ইত্যাদি।
১৯। মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনি উচ্চারণে প্রাণ বা শ্বাসবায়ুর প্রাবল্য দেখা যায়, তাই এদের মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-খ, ঘ, ছ, ঝুঠ, ঢ়, থ, ধ, ফ্, ভ্ ছাড়াও ‘ঢ়’ বাংলা মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি।
২০। ক্ষীণায়ন কী? উদাহরণ দাও।
উত্তর মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনির মতো উচ্চারিত হলে, তাকে ক্ষীণায়ন বলে। যেমন-মাঠ > মাট, বাঘ > বাগ, কাঁঠাল > কাঁটাল ইত্যাদি।
২১। পীণায়ন কী? উদাহরণ দাও।
উত্তর অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনির মতো উচ্চারিত হলে, তাকে পীণায়ন বলে। যেমন-থুতু > থুথু।
২২। ঘৃষ্ট ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে শ্বাসবায়ুর গতিপথ প্রথমে রুদ্ধ এবং পরে সামান্য মুক্ত হয়ে ঘর্ষণের মতো ধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাকে ঘৃষ্ট ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। সহজ কথায় বলা চলে এগুলি স্পর্শ ব্যঞ্জনধ্বনি ও উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনির যৌগিকরূপ। চ্, ছ, জ, ঝু বাংলা ভাষায় চারটি খৃষ্ট ব্যঞ্জনধ্বনি।
২৩। নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ধ্বনিগুলির উচ্চারণে শ্বাসবায়ু মুখবিবরের সঙ্গে সঙ্গে নাসারন্ধ্র দিয়েও নির্গত হয়, তাদের নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি বা অনুনাসিক ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। প্রত্যেক বর্গের পঞ্চম ধ্বনিটি নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি। যেমন-ঙ্, ঞ, ণ, ন, ম্। তবে যথার্থ নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি ঙ্, ন, ম্, কেন-না বাংলা উচ্চারণে = ং, এঞ = ন, ণ, ম্=ম্।
২৪। উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যেসব ব্যঞ্জনধ্বনিতে উষ্মা বা শ্বাসবায়ুর প্রাধান্য থাকে, তাদের উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। এদের উচ্চারণে বাতাস প্রলম্বিত হয়ে শিসের মতো ধ্বনি সৃষ্টি করে বলে, এদের শিসধ্বনিও বলে। বাংলায় শ, ষ, স্, হ উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি। উচ্চারণে ঠোঁট ও জিভ পিছিয়ে গেলে প্রশস্ত উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি হয়। যেমন-হ্। জিভ কুঞ্চিত হলে সংকীর্ণ উষ্ম ব্যঞ্জনধ্বনি হয়। যেমন-শ, স্, স্। বাংলার ভাষার ‘য’ ‘শ’ রূপে উচ্চারিত হয়। যুক্তব্যঞ্জন ব্যতীত ‘স্’ ‘শ’ রূপেই উচ্চারিত হয়। যেমন-‘স্থান’, ‘স্পৃহা’, ‘সাল’ ইত্যাদিতে ‘স’ উচ্চারিত হয়।
২৫। কম্পিত ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বাগ্র কম্পিত হয়ে উচ্চারণস্থান স্পর্শ করে, তাকে কম্পিত ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-চলিত বাংলায় ‘ব’ কম্পিত ধ্বনি।
২৬। পার্শ্বিক ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের সামনের ভাগ দন্ত্যমূল স্পর্শ করায় ধ্বনিবাহী বাতাস জিভের দু-পাশ দিয়ে বহির্গত হয়, তাকে পার্শ্বিক ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন-চলিত বাংলায় ‘ল্’ পার্শ্বিক ব্যঞ্জনধ্বনি।
২৭। তাড়নজাত ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের নীচের অংশ দাঁতের মূলে আঘাত বা তাড়না করে, তাকে তাড়নজাত ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।
যেমন-চলিত বাংলায় ডু ও ঢ়-এর উদাহরণ।
২৮। রণিত ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে জিভের অগ্রভাগ কাঁপে এবং ধ্বনিবাহী বায়ু নাক ও মুখগহ্বরে বারবার প্রতিফলিত হয়ে নাক, মুখ কিংবা একসঙ্গে নাক-মুখ দিয়ে প্রকাশ পায়; তাকে রণিত ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। চলিত বাংলায় র্, ন, ম্, এবং ল্ রণিত ব্যঞ্জনধ্বনি।
২৯। অন্তঃস্থ ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর স্পর্শধ্বনির এবং উষ্মধ্বনির মধ্যে অবস্থিত চারটি ধ্বনি য, র্, ল্, ব। এদের উচ্চারণে ধ্বনিবাহী বায়ু স্বরধ্বনির মতো বাধাহীন নয়, আবার ব্যঞ্জনধ্বনির মতো কঠিন বাধাযুক্ত নয়। সেইজন্য এদের অন্তঃস্থ ধ্বনি বলে। এরা না স্বর না ব্যঞ্জন। এদের মধ্যে ‘য’ ও ‘ব’ অর্ধস্বর, ‘র্’ ও ‘ল্’ তরল স্বর। বাংলায় অন্তঃস্থ ‘ব’-এর পৃথক উচ্চারণ নেই। অন্তঃস্থ ‘ব’, বর্গীয় ‘ব’ রূপেই উচ্চারিত হয়।
৩০। আশ্রয়ভাগী ধ্বনি কাকে বলে উদাহরণ দাও।
উত্তর যে ধ্বনি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনিকে আশ্রয় করে উচ্চারিত হয়, তাকে আশ্রয়ভাগী ধ্বনি বলে। যেমন-ং (অনুস্বর-স্বরের অনু বা পশ্চাতে বসে বলে এমন নাম), : (বিসর্গ)। ব্যঞ্জন ও স্বরের সঙ্গে এদের সংযোগ নেই কিন্তু উচ্চারণে এরা নানারকম বদল ঘটায়, সেজন্য এদের অযোগবাহ ধ্বনি বলে।
৩১। সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে?
উত্তর দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনের মধ্যে স্বরধ্বনি না থাকলে, তাদের সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। যেমন—চলিত বাংলায় প্রচলিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনগুলি হল, ক্ষ-ক্ + য্ = রাক্ষস > রাক্স।
৩২। ক্ষতিপূরণ দীর্ঘীভবন কাকে বলে?
৩২। ক্ষতিপূরণ দীর্ঘীভবন কাকে বলে?
উত্তর শব্দের কোনো যুক্ত বা যুগ্মব্যঞ্জনের একটি লোপ পেলে তার ক্ষতিপূরণস্বরূপ পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরের দীর্ঘস্বরে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ক্ষতিপূরণ দীর্ঘীভবন বলে।
উদাহরণ : সপ্ত > সত্ত > সাত। প্ত> ও> ত।
৩৩। দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে?
উত্তর একটিমাত্র ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের জন্য যে প্রযত্নের দরকার, তার মধ্যে দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হলে, তাকে দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি বলে। উদাহরণ: মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলি দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি। অল্পপ্রাণ সৃষ্ট ব্যঞ্জনের সঙ্গে হ-কার ধ্বনির মিশ্রণেই দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি সৃষ্টি হয়। যেমন-ক্+হ>খ, গ্+হ>ম্।
৩৪। উচ্চারণস্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিকরণ সারণির মাধ্যমে দেখাও।
৩৫। উচ্চারণ স্থান ও প্রকার অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিকরণ সারণির মাধ্যমে দেখাও।
৩৬। স্পর্শ ব্যঞ্জনধ্বনি কাকে বলে?
উত্তর ‘ক’ থেকে ‘ম’ পর্যন্ত ২৫টি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণকালে জিভ, কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা, দন্ত স্পর্শ করে বা ওষ্ঠাধর যুক্ত হয়। তাই এই পঁচিশটি ধ্বনিকে স্পর্শ ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।
৩৭। উচ্চারণস্থান অনুযায়ী স্পর্শধ্বনিগুলি কয়প্রকার ও কী কী?
উত্তর উচ্চারণস্থান অনুযায়ী স্পর্শধ্বনি পাঁচটি বর্গে বিভক্ত। প্রতি বর্গে পাঁচটি করে ধ্বনি আছে এবং বর্গের প্রথম ধ্বনির নামানুযায়ী বর্গ নাম করা হয়েছে। যেমন-
ক কবর্গ-ক্, খ, গ, ঘ, ঙ।
চবর্গ-চু, ছ, জ, ঝ, ঞ।
ট বর্গ-ট্, ই, ড্, ঢ, ণ।
তবর্গ-ত্ত, থ, দ, ধ, ন।
পবর্গ-প্, ফ, ব, ভ, ম্। বর্গানুযায়ী বিভাজিত হওয়ায় স্পর্শ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির আর-এক নাম বর্গীয় ব্যঞ্জনধ্বনি।
৩৮। অবর্গীয় ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি কী কী?
উত্তরা য, র, ল, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, এই ১৩টি বর্ণ বাংলা ভাষায় অবর্গীয় ধ্বনি হিসেবে পরিচিত।
৩৯। ক্, খ, গ, ঘ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর উচ্চারণে স্বাভাবিকতা বজায় থাকলেও মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম হয়। যেমন-কাক > কাগ, বাঘ > বাগ ইত্যাদি।
৪০। ‘ঙ’ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর ‘ঙ’-র উচ্চারণ উঁঅঁ। ‘ক্’ বর্গের পঞ্চম বর্ণটি কখনই শব্দের শুরুতে বা ব্যঞ্জনের পরে বসে না। ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণে উং হয়ে যায়। যেমন-রঙ > রং। স্বরধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হলে ‘গ’ ধ্বনির স্পর্শ পাওয়া যায় উচ্চারণে। যেমন-বাঙাল > বাঙ্গাল, রঙিন > রঙ্গিন ইত্যাদি।
৪১। চ, ছ, জ, ঝু ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর চ, ছ, জ, ঝু-এর চলিত বাংলায় উচ্চারণ স্বাভাবিক হলেও উপভাষায় উচ্চারণ বিকৃতি দেখা যায়। যেমন—বলছ > বলচ, সাঁঝ > সাজ। ‘জ’ ও ‘ঋ’-এর প্রকৃত উচ্চারণ ইংরেজি ‘z’ ও ‘zh’-এর মতো। বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে ‘জ’, ‘য’-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন-মাজতে, ভাজতে, জননী ইত্যাদি।
৪২। ‘ঞ’ ধ্বনির উচ্চারণ রীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর ‘ঞ’-র উচ্চারণ ইঁঅঁ। ‘ঞ’ শব্দের আদিতে বসে না। চ্, – ছ, জ, ঝু-এর আগে বসলে ‘ন’ উচ্চারিত হয়। যেমন-ঝঞ্ঝা > ঝন্ঝা, বঞ্চনা > বন্চোনা। ‘ঞ’ এবং ‘জ’ যুক্ত হলে ‘গ’ উচ্চারিত হয়। যেমন-যজ্ঞ > যগো, অজ্ঞান > অগ্গ্যান ইত্যাদি।
৪৩। ট, ঠ, ড্, ড্ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর ট্, ই, ড্, ঢ় ধ্বনির উচ্চারণ স্বাভাবিক হলেও কখনো-কখনো ব্যতিক্রম ঘটে। যেমন-কাঁঠাল > কাঁটাল। ড্ ও ঢ় অন্তে ডু ও ঢু হয়ে যায়। যেমন-বুড়ি, আষাঢ়। অন্ত্য ‘ঢ়’ ‘রহ্’ উচ্চারিত হয়- মূঢ় > মূরহ। অন্ত্য ‘ড্’ > ‘র্’ উচ্চারিত হয়-জড় > জর, বাড়ি > বারি। ‘ড্’-এর দ্বিত্ব হয়-বড্ড, গড্ডালিকা। কিন্তু ‘ট্’-এর দ্বিত্ব হয় না।
৪৪। ‘ণ’ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর বাংলা ভাষায় ‘ণ’ ধ্বনি ‘ন’ রূপে উচ্চারিত হয়। ৪৫। ত, থ, দ, ধ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর ত, থ, দ, ধ-এর উচ্চারণ স্বাভাবিক হলেও চলিত বাংলায় কোথায় > কোতায়, কথন > কতন হয়ে থাকে।
৪৬। প, ফ, ব, ভ্ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর প, ফ, ব, ভ-এর উচ্চারণ স্বাভাবিক। বাংলায় বর্গীয় ‘ব’ ইংরেজি ‘b’ ও অন্তঃস্থ ‘ব’ ইংরেজি ‘w’-র মতো উচ্চারিত হয়। ব-ফলার চারটি উচ্চারণ বাংলায় পাওয়া যায়।
কব-ফলা যোগে ব্যঞ্জনদ্বিত্ব-বিল্ব > বিল্ল, বিদ্বান > বিদ্দান।
দুয়ের বেশি বা কখনও একাধিকেও সংযুক্ত ‘ব’-ফলার খ উচ্চারণ নেই। যেমন-উচ্ছ্বাস, উজ্জ্বল।
তৎসম শব্দে হ্ + ব উচ্চারণ ইংরেজি w (উ অ)র মতো।
যেমন-বিহ্বল, জিহ্বা ইত্যাদি।
1 শব্দের শুরুতে ‘ব’ ফলা থাকলে উচ্চারণে শ্বাসাঘাত পড়ে। যেমন-স্বভাব, স্বজন।
৪৭। ‘ম’ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর ‘ম্’ ধ্বনির উচ্চারণ স্বাভাবিক এবং ‘ও-কার’-এর মতো। যেমন-ক্ষমতা > ক্ষমাতা, মজবুত > মোজবুত।
‘ম’ কখনো-কখনো অনুনাসিক হয়। যেমন—শ্মশান > শশান, আত্মা > আঁত্তা।
শব্দমধ্যস্থ ম্-এর উচ্চারণ স্বাভাবিক। যেমন-যুগ্ম > যুগ্মো, তন্ময় > তন্ময়।
‘ত’ বর্গে যুক্ত ‘ম্’ সংযুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণে দ্বিত্ব ঘটায়। যেমন-ছদ্মবেশ > ছদ্দবেশ, পদ্ম> পদ্দ।
যুক্তব্যঞ্জনে যুক্ত ‘ম্’-এর উচ্চারণ লুপ্ত হয়। যেমন-লক্ষ্মী > লখ্খি, সূক্ষ্ম > সূখ্খো।
৪৮। য, য ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর বাংলায় য= জ্। যেমন- যদু, যদি। ‘য়’ ইংরেজি ‘y’ জাতীয় ধ্বনি।
৪৯। ‘র’ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর ‘র্’ ধ্বনির উচ্চারণ স্বাভাবিক। এটি ‘র্’, ‘রেফ’ (‘), ‘র’ ফলা (এ) এবং বিসর্গ (ঃ) এই চারটি রূপে পাওয়া যায়।
কি শব্দের মাঝে বা শেষে ‘র’ ফলা থাকলে সংযুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণ দ্বিত্ব হয়। যেমন-বিব্রত > বিব্রোতো।
‘র্’ শব্দের আদিতে থাকলে দ্বিত্ব হয় না। যেমন-কৃশ, প্রভাত।
৫০। বাংলা ব্যঞ্জন ‘র’ ধ্বনির প্রয়োগ স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দাও।
উত্তর বর্ণরূপে-রবি, রাজা। রেফ () আকারে ব্যঞ্জনধ্বনির শীর্ষে-অর্থ, বর্ণ। অন্য ব্যঞ্জনের পর যুক্ত’র্’ ধ্বনি’র’-ফলা রূপ- গ্রহীতা, শ্রম।
৫১। শ, ষ, স্ ধ্বনির উচ্চারণরীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর বাংলায় তিনটি ধ্বনিই ‘শ’। কেবল যুক্তবর্ণে ‘স্’ উচ্চারণ হয়। যেমন-স্পষ্ট।
৫২। ‘হ’ ধ্বনির উচ্চারণ রীতি সম্পর্কে লেখো।
হ’-এর উচ্চারণ কখনও স্বরশূন্য নয়। ‘হ’ দুর্বলতম ব্যঞ্জনধ্বনি। ‘য’ ফলা যুক্ত ‘হ’ ধ্বনি শব্দের শুরুতে থাকলে স্বাভাবিক থাকে। যেমন-হ্যাঁ, হ্যারিকেন, হ্যারিপটার ইত্যাদি। শব্দের আদিতে না থাকলে ‘হ’ ও ‘য’ যথাক্রমে ‘জ’, ‘ক্’ হয়ে যায়। যেমন-সহ্য > সঝো, দাহ্য > দাঝো ইত্যাদি।
৫৩। হু, হ্ন-যুক্তবর্ণ দুটির পার্থক্য কোথায়?
উত্তর হ্ণ = হ্> ন, হ্ন = হ+ন।
৫৪। ‘ং’ ধ্বনির উচ্চারণ বাংলা ভাষায় কী হবে?
উত্তর ‘ং’ ধ্বনির উচ্চারণ বাংলা ‘ঙ’-র মতো। যেমন-ঢং (ঢ), সং (সঙ্)।
৫৫। বিসর্গ (ঃ) ধ্বনির উচ্চারণ রীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর বিসর্গ (ঃ)-এর বাংলায় উচ্চারণ নেই। শব্দের মাঝে বসলে পরের ধ্বনিটি দ্বিত্ব হয়। যেমন-দুঃখ দুখো। পদান্তে বিসর্গ (ঃ)-এর ব্যবহার বর্তমান বাংলা ভাষায় নেই।
৫৬। চন্দ্রবিন্দু (৩) ধ্বনির উচ্চারণ রীতি সম্পর্কে লেখো।
উত্তর উচ্চারণে চন্দ্রবিন্দু (৩)-এর স্বাভাবিক আগমন ঘটে। যেমন-ইঁট, পুঁথি। পূর্ববর্তী স্বরকে সানুনাসিক করে তোলে। যেমন-বংশ > বাঁশ, চন্দ্র > চাঁদ। সম্মানার্থে সর্বনামে ব্যবহৃত হয়। যেমন—তাঁর, যাঁরা, তাঁরা। হিন্দুধর্মে প্রয়াণচিহ্নরূপে এই বর্ণ ব্যবহৃত হয়।