বাংলার মেলা রচনা
![]() |
বাংলার মেলা রচনা |
“সোনালি রূপোলি মানুষের শিশু/ মানুষের সঙ্গে সমুদ্রে যায়…/ ওদের যাওয়া দরকার।”
-শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা
মিলনের আকুতি থেকেই মেলার সৃষ্টি। ধরাবাঁধা দৈনন্দিনতা থেকে মুক্ত হয়ে সম্প্রীতির সূত্র ধরে পরস্পরের হাত ধরা, আনন্দকে ভাগ করে নেওয়া মেলার মূল কথা। বাংলা দেশের শ্যামল সবুজ জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষ এমনিতেই অনুভূতিপ্রবণ। তাই এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলার যোগও অত্যন্ত প্রাচীন কাল থেকে। ধর্ম, লোকাচার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে, কখনও বা সমাজজীবনের নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলা দেশে মেলার বিস্তার ঘটেছে।
ধর্ম ও লোক-উৎসবকেন্দ্রিক মেলা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেছিলেন- “বাংলাদেশের মর্মে মর্মে ধর্ম…”। বাংলার মানুষ অসংখ্য লোকদেবতার পুজো করে। বছরের বিভিন্ন তিথিতে নির্দিষ্ট দেবতার পুজোকে উপলক্ষ্য করে বাঙালি উৎসবে মাতে। সেইসব দেবদেবীর মধ্যে শীতলা, চণ্ডী, সত্যপীর, মনসা কত কিছুই আছে। আর এই উৎসবের অঙ্গ হিসেবেই মেলার আয়োজন হয়। কোচবিহার কিংবা নদিয়ার শান্তিপুরে রাসযাত্রা উপলক্ষ্যে হয় রাসমেলা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগরে পৌষের শেষে হয় গঙ্গাসাগর মেলা। জলপাইগুড়িতে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে হয় জল্পেশের মেলা। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় টুসু পরব উপলক্ষ্যে মেলার আসর বসে।
বীরভূমের কেঁদুলিতে জানুয়ারি মাসে হয় বাউল মেলা, নদিয়ার আসাননগরের কদমখালিতে হয় লালন মেলা। এইসব মেলায় ধর্ম আচরণের থেকেও বাউল-ফকির-মুরশিদি শিল্পীদের গান এবং সম্মেলনে লোকসংস্কৃতির প্রাণবৈচিত্র্যেরই প্রকাশ ঘটে। পূর্ব মেদিনীপুরে মাঘ মাসে হয় ভীম মেলা, চৈত্রে চড়কের মেলা। পশ্চিম মেদিনীপুরে হয় গাজনের মেলা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত আর একটি মেলা হল বিষ্ণুপুর মেলা। একদা মল্লরাজাদের রাজধানী বিষুপুরে প্রতিবছর ডিসেম্বরের শেষে অনুষ্ঠিত হয় বিন্নুপুর উৎসব। উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলন এবং ধ্রুপদি নৃত্যের প্রদর্শনী এর উল্লেখযোগ্য দিক। ভারত সরকার একে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দিয়েছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয় বিষ্ণুপুর মেলা।
নগরায়ণ ও মেলার চরিত্র বদল
যত বেশি নগরসভ্যতার বিকাশ ঘটছে ততই মেলার নতুন নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারিভাবে কোনো এলাকার জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য মেলার আয়োজন হচ্ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে চা এবং পর্যটন উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা বসে দার্জিলিং-এ। দক্ষিণ দিনাজপুরে ফেব্রুয়ারিতে হয় তিস্তা-গঙ্গা উৎসব। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বর্ধমানের পানাগড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মাটি উৎসব। এটিকে কেন্দ্র করেও বসছে মেলা।
শহরের মেলা
একুশ শতকের শহরজীবনে সবই প্রয়োজনভিত্তিক। তাই মানুষের জীবনযাপন এবং মানসিক চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা, লিট্ল ম্যাগাজিন মেলা, নাট্যমেলা ইত্যাদি। নাগরিক মনন আর বুদ্ধিচর্চার আদানপ্রদানের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে এগুলি। শুধু শহরে নয়, মফস্সলেও এইসব মেলার প্রসার ঘটছে।
উপসংহার
মেলার মধ্যে মানবজীবন তার স্ফূর্তি খুঁজে পায়। তবে গ্রামীণ মেলার চরিত্র দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সংস্কৃতির বদলের ফলে এই পালটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবুও বাংলার প্রাণময়তার এক বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে মেলার গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
বাংলার কুটিরশিল্প রচনা 400+ শব্দে
বাংলার কুটিরশিল্প রচনা
![]() |
বাংলার কুটিরশিল্প রচনা |
ভূমিকা
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঙালির গৌরব। বাউলের গানে, মেয়েদের ব্রতকথায়, ভাদু-টুসুর পরবে, আরও অজস্রভাবে এই যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ঢাকাই মসলিন, বাঁকুড়ার টেরাকোটা, মেদিনীপুরের মাদুর কিংবা কৃয়নগরের মাটির পুতুল। সংস্কৃতি যদি হয় জাতির প্রাণময়তার উৎস, তাহলে সেই শিকড়ের সন্ধানে বাংলার কুটিরশিল্পের কাছে আমাদের যেতেই হবে।
কুটিরশিল্প কাকে বলে
একজন কারিগর নিজে, পরিবারের লোকজন বা মুষ্টিমেয় দু-একজনকে নিয়ে যদি কোনো শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করেন তাকে কুটিরশিল্প বলা হয়। কুটিরশিল্প সম্পূর্ণ গৃহকেন্দ্রিক। গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা যেমন ছিল কৃষিভিত্তিক, ঠিক তেমনই ছিল কুটিরশিল্প-নির্ভরও। এই শিল্পকে কেন্দ্র করেই সমাজে বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, যেমন-তাঁতি, কুমোর, কামার, শাঁখারি ইত্যাদি। অনেক সময়েই দেখা যেত এক-একটি এলাকা একটি বিশেষ দ্রব্য উৎপাদনে খ্যাতি অর্জন করেছে, ওই এলাকার অধিকাংশ পরিবারই যুক্ত থেকেছে সেই বিশেষ শিল্পের সঙ্গে। শিল্পীদের দক্ষতা উৎপন্ন দ্রব্যকে পৌঁছে দিয়েছে উৎকর্ষের শিখরে। তৈরি হয়েছে কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য।
বাংলার কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য
বাংলার কুটিরশিল্পের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্পের কথা। বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া পৃথিবী জুড়ে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃয়নগরে মৃৎশিল্প প্রসার লাভ করেছিল। শুধু মাটির পুতুল নয়, পণ্ডিতসভা, চড়ক উৎসব ইত্যাদি সামাজিক বিষয়কে মৃৎশিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ডোকরা শিল্প গড়ে উঠেছে। ধাতু দিয়ে মূর্তি, অলংকার ইত্যাদি তৈরি হলে তাকে বলে ডোকরা শিল্প। দেব-দেবীর মূর্তি থেকে অলংকার-ডোকরায় সবই তৈরি হয়। শান্তিনিকেতনে গড়ে ওঠে চর্ম শিল্পের নিজস্ব ঘরানা, মেদিনীপুরের মাদুর শিল্পের খ্যাতিও জগৎবিখ্যাত।
চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে ঢাকাই মসলিনের। রোম, গ্রিস,মিশর, ইংল্যান্ডে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। মোগল আমলে এই মসলিন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। মসলিনের শ্রেষ্ঠ রূপ ‘মলমল খাস’, যেখানে একটা গোটা শাড়ি আংটির ভিতর দিয়ে চলাচল করতে পারে। বাঙালি কারিগরের প্রতিভার বিস্ময়কর সৃষ্টি ছিল এই মসলিন। এ ছাড়াও ফুলিয়া এবং শান্তিপুরের তাঁত, বিষ্ণুপুরের বালুচরি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বাংলার কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য বহুদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে।
কুটিরশিল্পের বর্তমান অবস্থা
বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বাংলার কুটিরশিল্পের স্বর্ণযুগ এখন অস্তমিত। ইংরেজের চক্রান্তে বাংলার তাঁত শিল্পের যে সর্বনাশ ঘটেছিল, কৃত্রিম তন্তু থেকে তৈরি শাড়ি আমদানির মধ্য দিয়ে সেই সংকট থেকে তাঁত বা মসলিন শিল্প বেরোনোর পথ পায়নি। একদিকে বাজার ছোটো হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের কারিগরি পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সংকটের মূল কারণ। এর সঙ্গে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি তো আছেই। বিদেশের বাজারে চাহিদা থাকলেও বাংলার কুটিরশিল্প তাই আজ সংকটে।
উপসংহার
সরকারি স্তরে কুটিরশিল্প পুনরুজ্জীবনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ, কাঁচামালে ভরতুকির ব্যবস্থা করা, শিল্পীর উৎপাদিত পণ্য সরকারি সাহায্যে বাজারজাত করা, নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে আকর্ষণীয় করে তোলা—এসবের মধ্য দিয়ে কুটিরশিল্পের হৃত গরিমা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলার সংস্কৃতির এই গৌরবোজ্জ্বল দিকটিকে উপেক্ষার অর্থ নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা