নীলদর্পণ’ নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্রের বর্ণনা দাও। |
ভূমিকা:
সাময়িক পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থের মতো নাটক থেকেও উনিশ শতকের বাংলার সমাজচিত্র পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নাটকটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলার কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে এই নাটকটি রচিত।
বিষয়বস্তু:
কৃষকদের অভাব, দারিদ্র্য, নীলকরদের শোষণ-অত্যাচার, জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের দমনমূলক ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষকদের প্রতিরোধ, সংগ্রাম-এইসব নিয়ে তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন নীলদর্পণ নাটকে ফুটে উঠেছে। আর্থসামাজিক পটভূমিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষকেরা সাম্প্রদায়িকতার উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। আবার ইংরেজ আনুগত্য দূর করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি নীলচাষিদের সমর্থনে যেভাবে এগিয়ে এসেছিল নাটকটিতে তাও সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
উদ্দেশ্য:
এই নাটক রচনার উদ্দেশ্য ছিল-
1। ইংরেজদের শোষণ-অত্যাচার বন্ধ করা।
[2] কৃষকদের মঙ্গলসাধন করা।
3। মাটির মানুষের কাছাকাছি পৌঁছোনো ইত্যাদি।
নীলচাষিদের দুর্দশা :
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের পেশা ছিল চাষবাস। ধান বা খাদ্যশস্য চাষ ছিল এর মধ্যে প্রধান।
1 ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের প্রয়োজনে নীলের প্রচুর চাহিদা ছিল। সেজন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংরেজ খামার মালিকেরা দলে দলে ভারতে আসতে থাকে। এ ছাড়া ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতে ইউরোপীয়দের জমি কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তারা বেশি লাভের আশায় এলাকা চাষের বদলে বে-এলাকা চাষে আগ্রহী হয়।
[2] চাষিদের বিঘা প্রতি ২ টাকা দাদন দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত তারা। চাষিরা অসম্মত হলে নীলকররা চাষির গোরুবাছুর কেড়ে নিত, চাষির বাড়ি ভেঙে দিত, তাদের পরিবারের লোকজনকে মারধর করত।
[3] পঞ্চম রেগুলেশন আইন থাকা সত্ত্বেও চাষিরা নীলচাষ করতে বাধ্য হত। নীলের তুলনায় ধান বা তামাক চাষ বেশি লাভজনক ছিল। কিন্তু চাষিরা তা চাষ করতে পারত না। ফলে তারা খাদ্যাভাব ও ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়ত।
চাষিদের প্রতিরোধ:
নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচার নীলচাষিরা নীরবে মেনে নেয়নি। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীলচাষিরা প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। নাটকে নীলচাষি তোরাপের ভূমিকাতে তা স্পষ্ট। বাংলার হিন্দু-মুসলিম নীলচাষিদের ঐক্যবদ্ধ এই সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল।
শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির ভূমিকা :
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে নীলচাষিদের আন্দোলন শুরু হয়। এর মাত্র ২ বছর আগে সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) ঘটে। বাংলাদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করে। কিন্তু নীলচাষিদের আন্দোলনে তারা সহানুভূতি ও সমর্থন জানায়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা, শিশিরকুমার ঘোষের অমৃতবাজার পত্রিকা, আলোচ্য নীলদর্পণ নাটক নীলচাষিদের দুঃখদুর্দশা ও নীলকর সাহেবদের শোষণ-অত্যাচারের কাহিনি প্রচার করে। এর ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজ শাসন ও নীলকরদের শোষণের স্বরূপ বুঝতে পারে। তখন তারা নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। এই নাটকের অন্তর্গত গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ত্রী ও সাবিত্রী প্রভৃতি চরিত্রগুলি ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ।
মূল্যায়ন:
উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি ছিল নীলদর্পণ নাটক। পাশ্চাত্য ধারায় প্রভাবিত পঞ্চাঙ্ক নাটকের চরিত্রগুলি সংস্কৃত নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে। বাংলার অসহায় নীলচাষিদের লাঞ্ছনার মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে নাটকটিকে ঐতিহাসিক বলা যায়। সমকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের খণ্ডচিত্র নাটকটির মধ্যে ফুটে উঠেছে।