উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?
উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের কী প্রতিফলন লক্ষ করা যায়?

ভূমিকা: 

বাংলা ভাষার আদি বিকাশ পাল যুগে চর্যাপদের মাধ্যমে দেখা যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তার বিকাশ উনিশ শতকের আগে দেখা যায়নি। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বাংলা ভাষাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজে উদ্যোগী হয়। বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে সমকালীন বাঙালি সমাজের প্রতিফলন কীভাবে ঘটে তা নীচে আলোচনা করা হল।

বাংলা সংবাদপত্রে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন :

 উনিশ শতকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- বামাবোধিনী, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রভৃতি।

বামাবোধিনী পত্রিকা: 

বামাবোধিনী পত্রিকা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।
বাঙালি সমাজের প্রতিফলন: 

(ক) বামাবোধিনী পত্রিকা ছিল নারীদের জন্য প্রকাশিত বাংলা মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকা থেকে সমকালীন বাঙালি সমাজের নারীদের কথা বিশেষভাবে জানা যায়।
(খ) উনিশ শতকে বাংলার নারীশিক্ষা অবহেলিত ছিল। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করত শিক্ষিত মহিলারা অশুভ। সমাজে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
(গ) এই সময় সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। এই পত্রিকা থেকে সমাজে প্রচলিত কুপ্রথা সম্পর্কে জানা যায়।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা: 

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
বাঙালি সমাজের প্রতিফলন: 
(ক) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় বাংলার মানুষের জীবন, জীবিকা, ব্রিটিশ সরকার ও নীলকর সাহেবদের শোষণ সম্পর্কে জানা যায়।
(খ) উনিশ শতকের বাংলায় নীলকর সাহেবরা চাষিদের জোর করে নীলচাষ করাতো। তারা চাষিদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল।
(গ) এই সময় আদিবাসীদের জোর করে বেগার খাটানো-সহ বিভিন্নভাবে শোষণ ও অত্যাচার করা হত। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সাঁওতালরা বিদ্রোহ করে। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করে।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা: 

গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এর প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার।
বাঙালি সমাজের প্রতিফলন: 
(ক) গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে তৎকালীন বাংলার গ্রামের মানুষের কথা জানা যায়।
(খ) গ্রামের মানুষের উপর জমিদার ও মহাজনরা বিভিন্নভাবে শোষণ চালাত।
(গ) সমাজে নারীরা ছিল অবহেলিত। পুরুষশাসিত সমাজে কন্যা বিক্রয়, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ-সহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা প্রচলিত ছিল।

বাংলা সাময়িকপত্রে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন :

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দিগ্দর্শন হল বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িক পত্র। এটি ছিল শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন দ্বারা পরিচালিত। এরপর ওই মিশন থেকেই প্রকাশিত হয় মার্শম্যানের পরিচালনায় সমাচার দর্পণ। রামমোহন রায়ের সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশিত হয় এই যুগেই। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করেন সমাচার চন্দ্রিকা। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। সাময়িকপত্রের জগতে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন-এর আবির্ভাব একটি সাড়া জাগানো ঘটনা। বঙ্গদর্শনই প্রথম পাঠকদের কাছে উন্নত রুচির সাহিত্য পরিবেশন করে। এই সকল সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্রগুলিতে উনিশ শতকের বাংলার সমাজজীবনের বিভিন্ন দিকগুলি ছাড়াও নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চার পরিচয় মেলে।

উপসংহার: 

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলি তাদের সমালোচনা ও সংবাদ পরিবেশন দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে। সৃজনশীল উদ্যম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হয়। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সংগীত, সাহিত্য সমালোচনা, বাঙালির শক্তিসাধনা, কৃষক সমস্যা, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ক রচনা বাঙালির মননে বিপ্লব সৃষ্টি করে।

Leave a Comment