উনিশ শতকের নারীকল্যাণে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র অবদান আলোচনা করো। |
ভূমিকা:
উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সমাজজীবনে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্থবিরতা ছিল। বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশিরা কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও তা ছিল শুধুমাত্র বালকদের জন্য। সামাজিক ও পারিবারিক কারণে বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটজনক। এই দুরবস্থা থেকে নারীদের উদ্ধারের কাজে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রচার চালায়। এই পত্রিকাই হল নারীদের জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম মাসিক পত্রিকা।
প্রকাশকাল :
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ প্রথম প্রকাশিত হয়।
প্রকাশক :
‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।
‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র অবদান :
নারীশিক্ষা :
‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নারীশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিল। কারণ পত্রিকাটি ছিল ব্রাহ্মসমাজের। ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে নারীকল্যাণের বিষয়টি চিন্তা করেছিলেন। তারা মনে করতেন, সমাজের অর্ধেক অংশ যে নারীরা, তাদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে বাকি অর্ধেক অংশের উন্নতি হতে পারে না।
বাড়িতে লেখাপড়া:
বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বাড়ির মধ্যে লেখাপড়া করার জন্য ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পত্রিকা নারীশিক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ্যক্রমের প্রস্তাব করে। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষদের দায়িত্ব গ্রহণেরও প্রস্তাব দেয়। পত্রিকার প্রথম পাতায় তাই ‘কন্যায়েব পালনীয়া’- এই সংস্কৃত শ্লোকটি লেখা থাকত।
বিদ্যালয়ে লেখাপড়া:
এসময় বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ে সংকট দেখা দিলে পত্রিকাটি সমবেদনা প্রকাশ করে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের একটি সংখ্যায় পত্রিকাটি লিখেছিল, “আমরা শুনিয়া দুঃখিত হইলাম যে এ দেশের সর্বপ্রধান বেথুন বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৩০টি মাত্র ছাত্রী অধ্যয়ন করিতেছে।” “ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ পত্রিকার তথ্য উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থের অপচয় ও ছাত্রীসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ঘটনায় পত্রিকা দুঃখ প্রকাশ করে।
মিশনারিদের উদ্যোগে যেসব বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে প্রতি মাসে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র প্রকাশিত সংখ্যা পাঠানো হত। এভাবে শিক্ষাপ্রসারে এই পত্রিকা উৎসাহ দেয় এবং নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করে।
নারীসমাজের সংস্কার:
বামাবোধিনী পত্রিকা তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার দূর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকা সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অসম বা বার্ধক্য বিবাহের বিরোধিতা করেছিল। পাশাপাশি অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ প্রভৃতি প্রগতিশীল সংস্কারের সমর্থক ছিল।
আদর্শ অনুসরণ:
‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ বাঙালি নারীদের সামনে গার্গী, মৈত্রেয়ীর মতো বিদুষী নারীদের আদর্শ তুলে ধরে। পত্রিকায় লেখা হয়, সেই সুদূর অতীতে নিজ নিজ চেষ্টায় এইসব নারীরা জ্ঞান অর্জনে ব্রতী ছিলেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁরা যেভাবে পারদর্শিতা লাভ করেন, তাঁদের অনুসরণ করেই বাঙালি নারীদেরও শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসা দরকার।
আচার-অনুষ্ঠান পালন:
বাংলা হিন্দুসমাজে যেসব মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল সেগুলি পালনের কথা পত্রিকায় লেখা হত। যেমন- ভাইফোঁটা, রাখিবন্ধন, বিভিন্ন ব্রত প্রভৃতি। নারীদের এই অনুষ্ঠান পালন করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান বিষয়ক বিভিন্ন কথা ও কাহিনি লেখা হত। এগুলির উৎপত্তি ও গুরুত্বের কথাও থাকত সেই লেখায়।
বামাবোধিনী পত্রিকার সীমাবদ্ধতা:
এই পত্রিকা উনিশ শতকে বাংলার নারীসমাজের উন্নতির চেষ্টা করলেও তার বহু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন-
[1] এই পত্রিকা প্রচারিত হয় মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু নারীদের মধ্যে।
[2] পত্রিকা প্রচারিত হত কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে। ফলে গ্রামাঞ্চলের নারীদের কল্যাণ পত্রিকায় স্থান পায়নি।
[3] পত্রিকার পাঠিকাসংখ্যা সীমিত ছিল।
মূল্যায়ন:
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ বাংলা নারীকল্যাণে যে উদ্যোগ নিয়েছিল সমকালে আর কোনও পত্রিকা অনুরূপ উদ্যোগ নেয়নি। শিক্ষাপ্রসারে নারীসমাজকে সচেতন করার ক্ষেত্রে তাই এই পত্রিকার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।