হরপ্পাবাসীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও। |
ভূমিকা :
হরপ্পা সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম। খনন কার্যের ফলে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে যে সকল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করেই এই সুপ্রাচীন সভ্যতাটির রাজনৈতিক জীবনের কথা আমরা জানতে পারি।
রাজনৈতিক জীবন :
হরপ্পা সভ্যতায় কী ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার হলে হয়তো এই সভ্যতার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যাবে।
রাষ্ট্র কাঠামোর চরিত্র :
হরপ্পা সভ্যতার বিরাট এলাকা জুড়ে একই ধরনের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ওজন মাপ, পয়ঃপ্রণালী দেখে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন এখানে যে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রচলিত ছিল। তবে এই কেন্দ্রীয় শাসনের চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।
কেন্দ্ৰীভূত শাসন :
ড. এস কে সরস্বতী হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলির কাঠামো দেখে বলেন যে—এই প্রাচীন সভ্যতাটির একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ছিল। এই প্রশাসন জনগণের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত।
প্রজাতন্ত্র :
অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে হরপ্পা সভ্যতায় বণিকদের দ্বারা পরিচালিত একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার ছিল। বণিকদের সংগঠন গিল্ড শাসনকার্য পরিচালনা করত।
উদারনৈতিক স্বৈরশাসন :
ঐতিহাসিক এইচ ডি শাঙ্খালিয়া মনে করেন যে, একজন দৃঢ় উদারনৈতিক স্বৈরশাসক হরপ্পার শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন।
পুরোহিত তন্ত্র :
মর্টিমার হুইলার বলেন যে হরপ্পা সভ্যতায় একজন পুরোহিত রাজা (Priest King) শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি দৈব অধিকারের জোরে তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু রাখতেন।
পৌর শাসন :
ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন হরপ্পা সভ্যতায় একটি সুসংবদ্ধ পৌর শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কারণ তা না হলে প্রতিটি শহরে একই ধরনের নগর পরিকল্পনা কার্যকরী করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া প্রতিটি শহরে পুনঃনির্মাণ করা একইভাবে সম্ভব হত না। ঢাকা দেওয়া পয়ঃপ্রণালী ও ডাস্টবিন নিয়মিত পরিষ্কার করাও সম্ভব হত না।
দুটি রাজধানী :
ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট পিগট বলেন সুবিশাল এলাকার শাসন পরিচালনা করার জন্য দুটি রাজধানী ছিল। একটি হরপ্পাতে, অন্যটি মহেন-জো-দারোতে। তবে একজন শাসক বা রাজা সম্ভবত শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
ধর্মীয় জীবন :
হরপ্পা সভ্যতায় বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির ওপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিকরা এই সুপ্রাচীন সভ্যতাটির ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। হরপ্পা সভ্যতায় কোনো শহরে মন্দিরের ধ্বংস চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
i. মূর্তিপূজা :
হরপ্পা সভ্যতায় মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল।
a. দেবীমূর্তি :
হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত বিভিন্ন নারী মূর্তি এবং বিভিন্ন সিলে নারী মূর্তি থেকে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন এই সভ্যতায় মাতৃপূজার প্রচলন ছিল। এই নারী মূর্তির গায়ে ধোঁয়া | ও প্রদীপের শিখার চিহ্ন পাওয়া গেছে।
b. দেবমূর্তি :
একটি সিলে বাঘ, হাতি, গন্ডার, মোষ ও হরিণ এই পাঁচটি পশু দ্বারা বেষ্টিত তিনটি মস্তকবিশিষ্ট একটি ধ্যানমগ্ন যোগীপুরুষের মূর্তি পাওয়া গেছে। এই দেবমূর্তির মাথায় তিনটি শিং আছে। ঐতিহাসিক ব্যাসাম একে ‘আদি শিব’ বলেছেন। কারণ শিবকে পশুপতি বলা হয় ।
c. উর্বরতার দেবী :
অপর একটি সিলে উত্থান পদভঙ্গিতে একটি নগ্ন নারীমূর্তি অঙ্কিত আছে। এই নারী মূর্তির উদর থেকে একটি চারাগাছ বের হয়েছে। এই মূর্তি থেকে অনুমান করা হয় মাটিতে ফসল ফলা ও মেয়েদের মা হওয়াকে হরপ্পাবাসী এক বলে মনে করত। অনেকে এই মূর্তিকে ভূমাতার মূর্তি বলে মনে করেন।
d. অর্ধনর-অর্ধবৃষ :
সিন্ধুর একটি সিলে একটি অর্ধনর- অর্ধবৃষ মূর্তিকে একটি বাঘের সঙ্গে লড়াই করার ছবি পাওয়া গেছে। মনে করা হয় হরপ্পাবাসী এই মূর্তিটিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করত।
ii. প্রকৃতিপূজা :
হরপ্পাবাসী নদী, বৃক্ষ, অগ্নি, জল, সাপ, ষাঁড়, হাতি প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি ও জীবজন্তুদের দেবতা রূপে পূজা করত। কয়েকটি সিলে সূর্যের প্রতীক থেকে অনুমান করা হয় তারা সূর্যের উপাসনাও করত।
iii. প্রতীক পূজা :
হরপ্পা সভ্যতায় প্রতীক পূজার প্রচলন ছিল। চক্র চিহ্ন, স্বস্তিকা চিহ্ন, যোনি চিহ্ন এবং লিঙ্গের আকৃতিবিশিষ্ট পাথরখণ্ডকে তারা পূজা করত ।
iv. নরবলি :
হরপ্পা সভ্যতায় নরবলির প্রচলন ছিল। দেবীর উদ্দেশে নরবলি দেওয়া হত। একটি সিলে নরবলি দেওয়ার ছবি পাওয়া গেছে।