মেহেরগড় সভ্যতার অধিবাসীদের জীবিকা কী ছিল ? মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসের কারণগুলি লেখো।

মেহেরগড় সভ্যতার অধিবাসীদের জীবিকা কী ছিল ? মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসের কারণগুলি লেখো।
মেহেরগড় সভ্যতার অধিবাসীদের জীবিকা কী ছিল ? মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসের কারণগুলি লেখো।

ভূমিকা : 

1974 খ্রিস্টাব্দে জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডৌ বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের কাচ্চি সমভূমিতে বোলান গিরিপথের কাছে খননকার্য চালিয়ে তাম্র প্রস্তর যুগের মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে আমরা মেহেরগড়বাসীর জীবিকার কথা জানতে পারি।

জীবিকা : 

মেহেরগড় সভ্যতায় বসবাসকারী মানুষের প্রধান প্রধান জীবিকা ছিল পশুশিকার, পশুপালন, কৃষি, বিভিন্ন শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্য।

i. পশুশিকার : 

মেহেরগড় সভ্যতার প্রথম তিনটি পর্যায়ের (a.7000 BC থেকে 6000 BC, b. 6000 BC থেকে 5000 BC, C. 5000 BC থেকে 3600 BC) মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী। তাই ওই সময় তাদের প্রধান জীবিকা ছিল শিকার করা। তারা বনের পশু ও নদীর মাছ শিকার করে খেত।

ii. পশুপালন : 

মেহেরগড়বাসী পরবর্তীকালে পশুপালনকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেয়। খাদ্য ও চামড়ার জন্যই তারা পশুপালনের পেশা গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে তারা কৃষির প্রয়োজনে পশুপালন শুরু করেছিল। তাদের গৃহপালিত পশুগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গোরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, কুকুর প্রভৃতি।

iii. কৃষিকাজ : 

চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায় (3600 BC=2500 BC) বেশিরভাগ মেহেরগড়বাসীর জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। তাদের উৎপাদিত কৃষিজাত ফসলগুলি ছিল যব, গম, তুলা, খেজুর প্রভৃতি। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তারা কৃষিক্ষেত্রে জলসেচের ব্যবস্থা করত এবং উৎপাদিত শস্য সংরক্ষণ ও মজুত করার ব্যবস্থা করত।

iv. বাণিজ্য : 

মেহেরগড়ের বণিক সম্প্রদায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে দক্ষ ছিল। উদ্‌বৃত্ত কৃষিজাত পণ্য বাণিজ্যের অন্যতম পণ্য ছিল। তামার সিল দিয়ে বণিকরা পণ্য চিহ্নিতকরণ করত। এশিয়া মাইনর, পারস্য, আফগানিস্তান, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য চলত।

v. শিল্প : 

মেহেরগড়বাসী মৃৎশিল্প, বয়ন শিল্প, অলংকার শিল্প ও ধাতু শিল্পে বিশেষ পারদর্শী ছিল।

a. মৃৎশিল্প : 

প্রথম ভাগে মেহেরগড়বাসীর মাটির পাত্রগুলি ছিল হাতে তৈরি। পরবর্তীকালে কুমোরের চাকা ব্যবহার করে মৃৎশিল্পের উন্নতি ঘটায়। আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। মাটির পাত্র ছাড়াও নারী মূর্তি ও গবাদি পশুর মূর্তি তৈরি করত।

b. বয়ন শিল্প : 

মেহেরগড় সভ্যতার বয়নশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তারা তুলো থেকে সুতো তৈরি করে কাপড় বুনতে জানত। সেলাই করা বিভিন্ন রকম বস্ত্রের নিদর্শনও এই সভ্যতায় পাওয়া গেছে।

c. অলংকার শিল্প : 

মেহেরগড় সভ্যতার অলংকার শিল্পও বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। চুনি, নীলকান্ত মণি, লাপিস লাজুলি ও ছোটো শঙ্খ দিয়ে হার, বালা, আংটি তৈরি করত। এই সকল অলংকারের নিদর্শন সমাধিগুলি থেকে মিলেছে।

d. ধাতুশিল্প : 

মেহেরগড়বাসী তামা দিয়ে বিভিন্ন হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি তৈরি করত। এ ছাড়া ছুরি, বড়শি ও তুরপুন তৈরি করত।

e. অন্যান্য শিল্প : 

নলখাগড়া দিয়ে ঝুড়ি তৈরি, ঘর গরম করার চুল্লি তৈরি, সিল, গোলাঘর তৈরির নিদর্শন পাওয়া গেছে।

ধ্বংসের কারণ : 

ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা মেহেরগড় সভ্যতা দীর্ঘ অস্তিত্বের পর আনুমানিক 2500 খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধ্বংস হয়। এই সভ্যতার ধ্বংসের জন্য ঐতিহাসিকরা নিম্নলিখিত কারণগুলিকে দায়ী করেছেন—

i. প্রাকৃতিক বিপর্যয় : 

অনেক ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে বন্যা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে মেহেরগড় সভ্যতার পতন হয় ৷

ii. জলবায়ুর পরিবর্তন : 

অন্য একদল ঐতিহাসিক অনুমান করেন মেহেরগড় সভ্যতায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। দীর্ঘকাল ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সমগ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়। মানুষ অন্যত্র চলে যায়। ফলে ওই অঞ্চল জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

iii. হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে মিলন : 

অনেকে মনে করেন মেহেরগড় সভ্যতার মানুষ পরবর্তীকালে খাদ্য ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য হরপ্পা সভ্যতায় গিয়ে বসবাস করে ফলে মেহের গড়বাসী হরপ্পা সভ্যতায় মিশে যায়।

iv. বহিঃশত্রুর আক্রমণ : 

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান থেকে আগত বহিঃশত্রুর আক্রমণে মেহেরগড় সভ্যতার পতন ঘটে।

Leave a Comment