প্রাচীন মিশরের শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয় দাও।

প্রাচীন মিশরের শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয় দাও।
প্রাচীন মিশরের শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম ও সংস্কৃতির পরিচয় দাও।

ভূমিকা : 

মিশরীয় সভ্যতা বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম। এই প্রাচীন সভ্যতাটির শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।

শিক্ষা : 

প্রাচীন মিশরের শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্ররা বিদ্যালয়ে ভরতি হত। বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষাদান করতেন পুরোহিতরা। মিশরে উচ্চশ্রেণির মানুষের মধ্যেই বিদ্যাচর্চার প্রচলন ছিল। সাধারণ শ্রেণির অল্পসংখ্যক ছেলে পড়াশোনার সুযোগ পেত। তবে মেয়েদের বিদ্যাচর্চার সুযোগ ছিল না। লিপিকাররা মিশরে শিক্ষাবিস্তারে বিশেষ ভূমিকা নিতেন।

লিপি : 

প্রাচীন মিশরীয়রা লিপির ব্যবহার জানত। তাঁরা প্রতিটি অক্ষরের জন্য একটি পৃথক ছবি বা চিত্র ব্যবহার করত। মিশরের এই চিত্রলিপি হায়ারোগ্লিফিক নামে পরিচিত। মিশরীয়রা নলখাগড়ার কলম দিয়ে প্যাপিরাস গাছের পাতা বা কাদামাটির ফলকের উপর এই লিপিতে লিখত। এই লিপিতেই তারা বই ও চিঠিপত্র লিখত, বর্ষপঞ্জি তৈরি করত, রাজস্ব ও ব্যাবসার হিসাবপত্র রাখত। 1920 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি পণ্ডিত শাঁ পোলিয়ে এই লিপির পাঠোদ্ধার করেন।

সাহিত্য : 

প্রাচীন মিশরে সাহিত্য চর্চার বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল। গদ্য ও পদ্য উভয় ধারায় সাহিত্য চর্চা হত। ‘মৃতের পুস্তক’ (Book of the Death) ছিল তাদের বিখ্যাত ধর্মগ্রন্থ। ইখটানের রাজকীয় স্তুতি, মেমফাইট ড্রামা মিশরীয় সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এ ছাড়া অসংখ্য কবিতা, ছড়া, গল্প কাহিনি ছিল মিশরীয় সাহিত্যের সম্পদ।

বিজ্ঞান চর্চা : 

গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রভূত প্রাচীন উন্নতি ঘটে।

গণিত : 

পাটিগণিত ও জ্যামিতির উদ্ভব হয় প্রাচীন মিশরে। তারা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করার পদ্ধতি জানত। তারা দশমিকের ব্যবহার, ঘনফল ও ক্ষেত্রফল নির্ণয় করতে পারত। এমনকি ভগ্নাংশের হিসাবও তারা করতে পারত।

জ্যোতির্বিদ্যা : 

মিশরীয়রা বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে পারত। মিশরীয়রা সর্বপ্রথম 1 বছরকে 365 দিনে, 1 মাসকে 30 দিনে, 1 দিনকে 24 ঘণ্টায় ভাগ করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান : 

মিশরে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও উন্নতি ঘটে। তারা শল্যচিকিৎসা ও শারীরবিদ্যায় যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিল। চক্ষু, দন্ত, পাকস্থলি ও অন্ত্রের চিকিৎসাতে মিশরীয়রা বিশেষ পারদর্শী ছিল।

শিল্প : 

প্রাচীন মিশর ছিল শিল্পে যথেষ্ট উন্নত।

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : 

প্রাচীন মিশরে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পেরও বিশেষ উন্নতি ঘটে।

i. পিরামিড : 

মিশরীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল পিরামিড। বিখ্যাত পিরামিডগুলি হল খুফুর পিরামিড, তুতেনখামেনের পিরামিড, দ্বিতীয় রামেসিসের পিরামিড।

ii. মন্দির : 

মিশরীয় স্থাপত্যের অপর উল্লেখযোগ্য নিদর্শনটি হল—দেবতা আমনের মন্দির। এই মন্দিরটির উচ্চতা 25 মিটার। এর 130টি স্তম্ভ ও একটি বিরাট হলঘর ছিল। আবু সিম্বেল-এর মন্দিরটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল।

iii. স্ফিংক্স : 

বিশালাকৃতির স্ফিংক্স মূর্তিটি গিজোর পিরামিডের সামনে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মূর্তি। এর মুখমণ্ডল মানুষের মতো কিন্তু শরীরটি সিংহের মতো।

iv. অন্যান্য মূর্তি : 

এ ছাড়া কাঠ, পাথর ও মাটি দিয়ে মিশরীয় শ্রমিক, রাঁধুনি, ক্রীতদাস-এর মূর্তি তৈরি করা হত।

চিত্রকলা : 

চিত্রশিল্পেও প্রাচীন মিশরের অগ্রগতি ঘটেছিল। প্রথম ফ্যারাও মিনেসের রাজত্বকাল থেকেই মিশরে চিত্রশিল্পের উন্নতি লক্ষ করা যায়। মন্দির, রাজপ্রাসাদ, অট্টালিকার দেয়ালে বিভিন্ন রং দিয়ে ছবি আঁকা হত। ছবিগুলির বিষয়বস্তু ছিল রাজা, রাজপরিবার, উৎসবের নাচ-গান, কৃষক ও কর্মরত কারিগর প্রভৃতি। উজ্জ্বল রং দিয়ে রাজার ছবি এবং অনুজ্জ্বল রং দিয়ে সাধারণ মানুষের ছোটো ছোটো ছবি আঁকা হত। 

ধর্ম : 

মিশরীয়গণ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি, জীবজন্তু ও বহু দেবদেবীর পূজা করত। প্রথমে মিশরীয়দের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেবতা রা। পরবর্তীকালে রা যুদ্ধের দেবতায় পরিণত হলে বাস্তু দেবতা আমন মিশরীয়দের প্রধান দেবতার আসন লাভ করে। অন্যান্য দেবদেবীর মধ্যে আকাশের দেবতা হোরাস, উর্বরতার দেবী আসিরিস, পাপপুণ্য বিচারের দেবী আইসিস উল্লেখযোগ্য।

সংস্কৃতি

মমি : 

মিশরীয়রা বিশ্বাস করত মৃত্যুতে জীবনের শেষ : নয়। মৃত্যুর পরও জীবন আছে। মৃতদেহের মধ্যে আত্মা বেঁচে থাকে। তাই মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয়স্বজন মৃতদেহটিকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও সুগন্ধি মাখিয়ে কয়েকটি কাপড় জড়িয়ে সংরক্ষণ করত। এই সংরক্ষিত মৃতদেহটিকে মমি বলা হয়।

সমাধিস্থল : 

মিশরের ফ্যারাওদের সমাধিস্থলকে মৃত্যুপুরী বা নেক্রোপোলিস বলা হয়। থিবস নগরের চার বর্গমাইল জায়গা জুড়ে মৃত্যুপুরী অবস্থিত ছিল। রাজাদের সমাধিস্থল বা মৃত্যুপুরীর নাম ভ্যালি অব্ কিংস, রানিদের সমাধিস্থল ভ্যালি অফ কুইনস নামে পরিচিত।

মূল্যায়ন : 

উপরের আলোচনা থেকে বলতে পারি মিশরীয়গণ প্রাচীনকালে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে তাদের সাফল্য পার্শ্ববর্তী স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্ষপঞ্জি তৈরি, অর্থাৎ ক্যালেন্ডার তৈরির জন্য আমরা এই সভ্যতার কাছে ঋণী। আর মিশরীয় স্থাপত্য পিরামিড আজও মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

Leave a Comment