নদীমাতৃক সভ্যতা কাকে বলে? নদীর তীরে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার কারণগুলি লেখো।

নদীমাতৃক সভ্যতা কাকে বলে? নদীর তীরে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার কারণগুলি লেখো।
নদীমাতৃক সভ্যতা কাকে বলে? নদীর তীরে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার কারণগুলি লেখো।

নদীমাতৃক সভ্যতার সংজ্ঞা : 

পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। নদীর তীরে গড়ে-ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলিকে নদীমাতৃক সভ্যতা বলা হয়। যেমন—সিন্ধু নদীর উপত্যকায় হরপ্পা সভ্যতা, নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমিয়া ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, ইয়াং সিকিয়াং ও হোয়াং হো নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতা। আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে বিভিন্ন নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির বিকাশ ঘটেছিল।

নদীতীরে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার কারণ 

বিভিন্ন নদীর তীরে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার পেছনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—

i. অনুকূল আবহাওয়া : 

নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হয়। এই আরামদায়ক আবহাওয়ার জন্য প্রাচীন মানুষ নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে।

ii. পানীয় জলের সুবিধা : 

প্রাচীনকালে আদিম মানুষের পানীয় জলের একমাত্র উৎস ছিল নদীর জল। পানীয় জলের সুবিধার জন্য নদীর তীরবর্তী অঞ্চল তাদের খুব পছন্দ ছিল। তাই তারা নদীর ধারে বসবাস করে।

iii. উর্বর জমি : 

নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের জমি খুব উর্বর হয়। কারণ বর্ষাকালে বন্যার সময় নদীর হয়। জমিতে প্রচুর পলি পড়ে। এই পলিমাটিতে ভালো ফসল হয়। শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আদিম মানুষ নদীর তীরের পাশে বসতি তৈরি করে।

iv. জলসেচের সুবিধা : 

কৃষিকাজের জন্য জলসেচের দরকার হয়। নদীর উপকূলে চাষ করলে নদীর জল সেচের কাজে ব্যবহার করার সুবিধা হয়। নদীতে বাঁধ দিয়ে নদী থেকে খাল কেটে নদীর জল কৃষিজমিতে জলসেচ করা যায়। জলসেচ দিলে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাই কৃষির সুবিধার জন্য মানুষ নদীর তীরে দলগতভাবে বসতি গড়ে তুলেছিল।

v. পশুপালনের সুবিধা : 

নদীর তীরবর্তী অঞ্চল উর্বর হওয়ার ফলে প্রচুর ঘাস জন্মায়। গৃহপালিত পশুর প্রধান খাদ্য হল ঘাস। তাই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গৃহপালিত পশুর খাদ্যের অভাব ছিল না। পশুচারণের সুবিধার জন্য নদীর তীর তাদের পছন্দ ছিল। তা ছাড়া নদীর তীরে ফসলের সুরক্ষার জন্য তারা নদীর তীরেই বাসস্থানগুলি নির্মাণ করে।

vi. মাছ শিকার : 

আদিম মানুষ কৃষিকাজে নিযুক্ত হওয়ার ফলে মাংস সংগ্রহের পরিমাণ হ্রাস পায়। নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। মানুষ উন্নত হাতিয়ার ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরে মাংসের ঘাটতি পূরণ করে নেয়। নদীর মাছ আদিম মানুষের অন্যতম খাদ্যে পরিণত হয়। এই জন্য মানুষ নদীর তীরে বসবাস করা শুরু করে।

vii. যোগাযোগ ও পরিবহণ : 

প্রাচীনকালে যখন স্থলপথ তৈরি হয়নি তখন নদীর জলপথগুলি ছিল স্বাভাবিক পথ। নৌকা বা ডিঙির সাহায্যে মানুষ একস্থান থেকে সহজে অন্যস্থানে যাতায়াত বা কৃষিজাত পণ্য পরিবহণ করত। যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণের সুবিধার জন্য আদিম মানুষ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলকেই বসবাসের জন্য নির্বাচন করে।

viii. নিরাপত্তা : 

কৃষিজমি ও গৃহপালিত পশুর অধিকার নিয়ে আদিম মানুষের গোষ্ঠী সংঘর্ষ লেগেই থাকত। উর্বর কৃষিজমি দখলের জন্য একটি গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীকে আক্রমণ করত। তাই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জলভাগহীন বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করলে অন্য গোষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু নদীর বিস্তীর্ণ জলভাগ অতিক্রম করে হঠাৎ করে আক্রমণ করা সম্ভবপর নয়। আদিম মানুষ এই বিষয়টি উপলব্ধি করে নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে।

ix. অবসর যাপন : 

নদীর তীরে পলিমাটিতে অধিক ফসল হওয়ায় মানুষ খাদ্য সংগ্রহের জন্য কম সময় ব্যয় করত। উদ্‌বৃত্ত ফসল জমা থাকার ফলে মানুষ অবসর সময়ে মৃৎশিল্প, বয়ন শিল্প, দারুশিল্প, হাতিয়ার নির্মাণে ব্যয় করে। আরও পরে নৃত্যচর্চা, সংগীত চর্চা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, খেলাধুলা ও শরীরচর্চাতে গুরুত্ব দেয়।

মূল্যায়ন : 

জল ছাড়া যেমন জীবন সম্ভব নয় তেমনি জল ছাড়া সভ্যতা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। দৈনন্দিন জীবনে স্নান, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসনকোশন পরিষ্কার, রান্না করার কাজে জল দরকার। নদীর জল এই সব কাজে ব্যবহার করা হয়। নদী কৃষি ও পশুপালনের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করে মানুষের অর্থনীতিও সুনিশ্চিত করেছে। নদীর জলপথ পণ্য পরিবহণ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আদিম মানুষ এই সব প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে। এর ফলে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির বিকাশ ঘটে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে।

Leave a Comment