তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা কীরূপ ছিল? অথবা, তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষের সংস্কৃতির পরিচয় দাও।

তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা কীরূপ ছিল?
তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা কীরূপ ছিল?

ভূমিকা : 

নব্য প্রস্তর যুগের পর পৃথিবীতে যে যুগের সূচনা হয় তা তাম্র প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত। নব্য প্রস্তর যুগের শেষভাগে মানুষ তামা আবিষ্কার করে। এই সময় মানুষ পাথরের পাশাপাশি তামার ব্যবহার শুরু করে। এজন্য প্রত্নতত্ত্ববিদ রেমন্ড অলচিন ও ব্রিজেৎ অলচিন এই যুগকে তাম্র প্রস্তর যুগ বলে অভিহিত করেছেন।

সময়কাল : 

তাম্র প্রস্তর যুগের সূচনা হয় আনুমানিক ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং শেষ হয় 3000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সুমের মানুষ প্রথম তামা আবিষ্কার করে। 3000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অংশে তামার ব্যবহার যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। তবে আমেরিকায় ব্যবহার শুরু হয় আরও দেরিতে।

নিদর্শন : 

তাম্র প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রাচীন ভারতবর্ষের মেহেরগড়ে, প্রাচীন মিশরে, মেসোপটেমিয়াতে এবং এশিয়া মাইনরে।

তামার ব্যবহার : 

পাথরের সঙ্গে মিশে থাকা তামাকে আগুনে গলিয়ে তাম্র প্রস্তর যুগের মানুষ বিশুদ্ধ তামা সংগ্রহ করত। উত্তপ্ত গরম তামাকে ছাঁচে ঢেলে তারা লাঙলের ফলা, তিরের ফলা, বর্শা, কুঠার, কুড়ুল প্রভৃতি হাতিয়ার তৈরি করে।

তামা ব্যবহারের কারণ : 

তামা ব্যবহারের কারণ হল—i. তামার হাতিয়ারগুলি পাথরের তুলনায় অনেক মজবুত, ii. তামার হাতিয়ার পাথরের তুলনায় অনেক বেশি ধারালো ও তীক্ষ্ণ।

সভ্যতার বিস্তার : 

তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষ নদীর তীরে বাসস্থান গড়ে তোলে। মূলত কৃষির প্রয়োজনেই নদীতীরে বসতি স্থাপন করায় ধীরে ধীরে বসতিগুলি গ্রামে পরিণত হয়। তাম্র প্রস্তর যুগের শেষভাগে মানুষ রোদে পোড়া ইট দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করতে শেখে।

সমাজজীবন : 

তাম্র প্রস্তর যুগে মানবসমাজ ছিল ‘পিতৃতান্ত্রিক’। এই সময় সমাজে পুরুষদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। পুরুষদের নির্দেশ মতো পারিবারিক ও সামাজিক কাজগুলি পরিচালিত হয়। পুরুষরা পরিবার, দল ও জাতির প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে প্রস্তর যুগের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পতন হয় ৷

খাদ্যাভ্যাস : 

তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে। আগুনের উপর তামার পাত্র বসিয়ে রান্না করতে শেখে। ফলে মানুষ রান্না করা খাবার খেতে শুরু করে।

পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী : 

তাম্র প্রস্তর যুগে কৃষিজীবী গোষ্ঠী, পশুপালক গোষ্ঠী, কারিগরি গোষ্ঠী, বণিক গোষ্ঠী প্রভৃতি পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। কৃষির সঙ্গে পশুপালনের নিবিড় সম্পর্ক থাকার ফলে কৃষিজীবী গোষ্ঠী ও পশুপালক গোষ্ঠী পাশাপাশি বাসস্থান গড়ে তোলে।

গোষ্ঠী সংঘর্ষ : 

কৃষিজমি ও পশুর জন্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এযুগে সংঘাত শুরু হয়। শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলির নেতারা দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে উদ্যত হয়। ফলে সমাজে গোষ্ঠী সংঘর্ষ শুরু হয়।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি : 

এযুগে তামা দিয়ে চাকা নির্মিত হওয়ার ফলে চাকাগুলি অনেক মজবুত ও টেকসই হয়। এরফলে তামার চাকাযুক্ত গাড়ির সাহায্যে মানুষ বহুদূর পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন ও পণ্য পরিবহণ করতে সমর্থ হয়।

উৎপাদন বৃদ্ধি : 

তামার তৈরি লাঙল, কোদাল, কাস্তে ব্যবহারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

বাজার তৈরি : 

উদ্‌বৃত্ত ফসল বিক্রির জন্য তাল প্রস্তর যুগে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বাজার গড়ে ওঠে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্য বেচা-কেনার জন্য বাজারে সমবেত হয়।

রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম : 

উদ্‌বৃত্ত ফসলের অসম বণ্টনের ফলে সমাজে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির উদ্ভব হয়। ধনীরা তাদের অর্থবলকে কাজে লাগিয়ে সমাজের বা গোষ্ঠীর শাসকে পরিণত হয়। এই ধনী শাসকশ্রেণি সমস্ত ক্ষমতাকে দখল করে। এইভাবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হয় ।

মূল্যায়ন : 

তাম্র প্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাপনের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পতন ঘটে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্ম হয়। পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। সম্পদের অসম বণ্টনের ফলে শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রকাঠামোর উদ্ভব হয়।

Leave a Comment