এথেন্সের গণতন্ত্রের ভিত্তি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়? পলিসগুলির পতনের কারণগুলি লেখো।

এথেন্সের গণতন্ত্রের ভিত্তি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়? পলিসগুলির পতনের কারণগুলি লেখো।
এথেন্সের গণতন্ত্রের ভিত্তি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়? পলিসগুলির পতনের কারণগুলি লেখো।

এথেন্সে
গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা

এথেন্স হল গণতন্ত্রেরসূতিকাগার গণতান্ত্রিক শাসন
কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এথেন্স কেবলমাত্র পথপ্রদর্শক তা নয়, ইউরোপ
তথা সমগ্র বিশ্বের পথপ্রদর্শক। এথেন্সের গণতন্ত্রের ভিত্তিটিকে মজবুত করে গড়ে তোলেন সোলান, ক্লেইস্থিনিস, এফিয়ালটিস পেরিক্লিসের মতো
মহান ব্যক্তিবর্গ।

শাসন
সংগঠন

এথেন্সের শাসন কাঠামোর চারটি প্রধান অংশ ছিল—i. সমিতি অর্থাৎ একলেজিয়া, ii. পরিষদ অর্থাৎ অ্যারিওপাগাসের কাউন্সিল, iii. ম্যাজিস্ট্রেট অর্থাৎ আরকন  iv. জুরি
আদালত অর্থাৎ হেলাইয়া

i. একলেজিয়া

এথেন্সের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক একলেজিয়ার সদস্য ছিলেন। এথেন্সের শাসনব্যবস্থায় একলেজিয়ার ক্ষমতা ছিল সর্বাধিক। নাগরিকগণ এই সমিতির সভায়
উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত প্রয়োজনীয় আইন
তৈরি করত।

ii. অ্যারিওপাগাসের
কাউন্সিল

সোলান এথেন্সের নাগরিকদের চারটি শ্রেণি বা ট্রাইবে বিভক্ত
করেন। প্রতিটি ট্রাইব থেকে 100 জন করে সদস্য
নিয়ে মোট 400 জন সদস্য দ্বারা
এই কাউন্সিল গঠিত হয়। পরে ক্লেইস্থিনিস কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা 100 জন বৃদ্ধি করেন।
এর ফলে কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যা হয় 500 জন। বর্তমান আইনসভার উচ্চকক্ষগুলির পূর্বসূরি ছিল এই পরিষদ।

iii. আরকন

এথেন্সের ম্যাজিস্ট্রেটগণ আরকন নামে পরিচিত ছিল। এরা রাজ্যের পরিবর্তে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন সোলানএর
সংস্কার অনুসারে আরকনগণপেন্টিকেসি মেডিমনয়
হিপ্পিশ্রেণি থেকে নিযুক্ত হত। পরে পেরিক্লিসের সংস্কার অনুসারে সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে থেকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

iv. হেলাইয়া

এথেন্সের গণ আদালতের নাম
ছিল হেলাইয়া। এই আদালতটি প্রতিষ্ঠা
করেনসোলান এর বিচারকরা
লটারির মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হতেন। প্রথমে আরকনদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে বিচার শুরু হত। পরবর্তীকালে হেলাইয়ার বিচারকগণ স্বয়ংক্রিয় হয়ে আরকনদের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচার করতে পারার অধিকার পায়। ফলে হেলাইয়া সংবিধান গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা
হিসেবে আরকনদের নিয়ন্ত্রণ করত।

মূল্যায়ন

এথেন্সের গণতন্ত্রের কতকগুলি ত্রুটি ছিল। যেমনক্রীতদাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। তা সত্ত্বেও আধুনিক
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পূর্বসূরি এথেন্সের গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো ছিল প্রশংসনীয়। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। নাগরিকরা প্রত্যক্ষভাবে শাসন পরিচালনাতে অংশগ্রহণ করত।

পলিসগুলির
পতনের কারণ :

গ্রিক
পলিসগুলির দীর্ঘ গৌরবময় অস্তিত্বের পর খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ
শতকে পতন ঘটে। পলিসগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব, সামরিক অর্থনৈতিক দুর্বলতা
পতনের পথকে প্রশস্ত করে। অবশেষে ম্যাসিডনের আক্রমণে পলিসগুলির পতন হয়।

i. পলিসগুলির
অনৈক্য

পলিসগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব পলিসগুলির পতনের অন্যতম কারণ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্যের আক্রমণ পলিসগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে গ্রিস পলিসগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দুটি প্রধান পলিস এথেন্স স্পার্টা দীর্ঘ
যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। শক্তিশালী এথেন্সকে পরাজিত করে স্পার্টা জয়লাভ করে। কিন্তু দুটি পলিসই দুর্বল হয়ে পড়ে। শক্তিশালী ম্যাসিডনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। একে একে সব টি
পলিসের পতন হয়।

ii. অর্থনৈতিক
দুর্বলতা

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পলিসগুলির অর্থনৈতিক সংকট চরমে ওঠে। কৃষকদের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করার ফলে কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হয়। অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর পলিসগুলি বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে পলিসগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এর ফলে বাণিজ্যের
যেমন ক্ষতি হয় তেমনি পলিসগুলির ঐক্য বিনষ্ট হয়। অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য সামরিক ব্যয়ভার বহন করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে।

iii. সামরিক
ত্রুটি

সামরিক বিভাগের ত্রুটিগুলি পতনের অন্যতম কারণ ছিল।

a. ভাড়াটে
সৈন্যবাহিনী

পলিসগুলির সৈন্যবাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্যের সংখ্যা বেশি ছিল। ফলে সৈন্যবাহিনীর কোনো দেশপ্রেম ছিল না। কঠিন পরিস্থিতির সন্মুখীন হলে তারা জীবন রক্ষার জন্য পালিয়ে যেত।

b. স্থায়ী
সৈন্যবাহিনীর অভাব

পলিসগুলির কোনো স্থায়ী সৈন্যবাহিনী ছিল না। যুদ্ধের সময় কৃষকদের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করা হত। কৃষিকাজের জন্য কৃষকরা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়াতে চাইত না। ফলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পলিসগুলি ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া কৃষকরা
সমতলে যুদ্ধে পারদর্শী হলেও পার্বত্য অঞ্চলে কঠিন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের সময় ব্যর্থ হত।

c. নৌবাহিনীর
অভাব

সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন গ্রিসের প্রতিরক্ষার জন্য শক্তিশালী নৌবাহিনীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য পলিসগুলির নৌশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এথেন্স তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য অন্যান্য পলিসগুলির নৌশক্তি ধ্বংস করে। কিন্তু পরবর্তীকালে এথেন্সের ধনী পরিবারগুলি নৌবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করতে অস্বীকার করে। এর ফলে বিদেশি
আক্রমণ প্রতিরোধের সময় এথেন্সের পক্ষে অন্যান্য পলিসগুলি থেকে নৌশক্তিকে সমবেত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

d. সুদক্ষ
সেনাপতির অভাব

যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পলিসগুলিতে যোগ্য সেনাপতির অভাব ছিল। ফলে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করতে পলিসগুলি ব্যর্থ হয়।

iv. স্বৈরতান্ত্রিক
শাসন

পলিসগুলির শাসকশ্রেণি পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি কেড়ে নেয়। সমিতি পরিষদগুলির ক্ষমতা
হ্রাস করে ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জনগণের আন্দোলন করার অধিকার খর্ব করে। ফলে পলিসগুলি জনসমর্থন হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।

v. ক্রীতদাসদের
ওপর নির্ভরতা

পলিসগুলির নাগরিকরা ক্রীতদাসদের কৃষি, খনি কুটিরশিল্পে নিয়োগ
করে বিলাসিতার জীবন কাটাত। এর ফলে নাগরিকগণ
অলস পরিশ্রমবিমুখ হয়ে
পড়ে। তাই এই ক্রীতদাস প্রথা
পলিসগুলির পতনের অন্যতম কারণ ছিল।

vi. রক্ষণশীলতা

গ্রিকদের রক্ষণশীল মানসিকতা পলিসগুলির পতনের একটি অন্যতম কারণ ছিল। ক্রীতদাসদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য গ্রিকদের কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প খনিতে কোনো
নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করার আগ্রহ ছিল না। এর ফলে উৎপাদন
ব্যাহত পলিসগুলি আর্থিক
দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে।

vii. ব্যক্তিস্বার্থ

পলিসগুলির অধিবাসীদের স্বার্থপরতা পলিসগুলির পতনের অন্যতম কারণ ছিল। রাষ্ট্রের স্বার্থ অপেক্ষা ব্যক্তিস্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে পলিসগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে।

viii. অনাগরিকদের
সংখ্যা বৃদ্ধি

ক্রীতদাস বিদেশিদের নাগরিকত্ব
ছিল না। এর ফলে রাজনৈতিক
কারণে বহু লোককে নির্বাসিত করলে পলিসগুলিতে নাগরিকদের তুলনায় অনাগরিকদের সংখ্যা বহু বৃদ্ধি পায়।

ix. প্রত্যক্ষ কারণ

ম্যাসিডনের আক্রমণ পলিসগুলির পতনের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। আর্থিক সামরিক দিক
থেকে দুর্বল পলিসগুলি ম্যাসিডনের সুদক্ষ বাহিনীর আক্রমণে পরাজিত হয়। ম্যাসিডন একের পর এক পলিস
দখল করে নেয়। পলিসগুলির পতনের পর ম্যাসিডোনীয় সাম্রাজের
উদ্ভব হয়।

Leave a Comment