বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা/কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ/বিভূতিভূষণ ও বাংলা সাহিত্য
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা – রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও শরৎচন্দ্রের পর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় নাম। গ্রামবাংলার প্রকৃতি, দরিদ্র মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তিনি রঙে, রসে, গল্পে, উপন্যাসে রূপ দিয়ে গেছেন।
ভূমিকা :
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও শরৎচন্দ্রের পর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় নাম। গ্রামবাংলার প্রকৃতি, দরিদ্র মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তিনি রঙে, রসে, গল্পে, উপন্যাসে রূপ দিয়ে গেছেন।
জন্ম ও বাল্যকাল :
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচড়াপাড়ার কাছে মুরাতিপুর গ্রামে মাতলালয়ে বিভূতিভূষণের জন্ম। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বনগাঁর কাছে চালকি ব্যারাকপুরে। বিভূতিভূষণ অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবিকা ছিল পূজার্চনা ও কথকতা। বিভূতিভূষণ ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির।
শিক্ষা :
ব্যারাকপুরে গ্রামের পাঠশালায় বিভূতিভূষণের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে তিনি বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ভরতি হন রিপন কলেজে। আইন এবং বিএ পাস করেন কৃতিত্বের সঙ্গে। ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার জন্য ভরতি হন। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
কর্মজীবন ও সাহিত্যকীর্তি :
বিভূতিভূষণের কর্মজীবনের সূচনা শিক্ষকতা দিয়ে। কিন্তু তিনি চিরপথিক। ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে’ এই আহ্বান তিনি শুনতে পান। বিহারের অরণ্যপ্রকৃতি তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভাগলপুরের পূর্ণিয়া জেলার জঙ্গলমহলের তদারকির জন্য ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে তিনি বিশ্বখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাস হল ‘আরণ্যক’, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘ইছামতী’ প্রভৃতি। তাঁর অসামান্য কয়েকটি ছোটোগল্প হল ‘যাত্রাবদল’, ‘মৌরীফুল’, ‘মেঘমল্লার’, ‘জলসত্র’ প্রভৃতি। শিশু সাহিত্যেও তাঁর অগাধ দক্ষতা ছিল। ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘হীরামানিক জ্বলে’ কিংবা ‘অরণ্য মর্মর’ প্রভৃতি তাঁর অন্যতম শিশুসাহিত্য।
প্রকৃতিপ্রেম :
প্রকৃতি বিভূতিভূষণের কাছে অপরিহার্য অঙ্গরূপেই অঙ্গীকৃত। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে প্রকৃতিই মুখ্য। মানুষ এখানে গৌণ। প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের এই অন্তরঙ্গতা বাংলা উপন্যাসে বিরল। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে জীবনের দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণা অপেক্ষা অরণ্যভূমি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই তিনি কালোত্তীর্ণ স্রষ্টাদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন। শুধু প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে নয়, কিশোর প্রেমের রূপকার হিসেবে তিনি আজও স্মরণীয়।
অন্তিমপর্ব :
বিহারের শাল পিয়ালের বন তাঁকে মাঝেমাঝেই আকর্ষণ করত। তাই ঘাটশিলায় একটি বাসগৃহও তিনি কিনেছিলেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর সপরিবারে পূজার ছুটি কাটাতে তিনি গেলেন ঘাটশিলাতে। সেখানেই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে পথিক কবি বিভূতিভূষণ মাটির মায়া ত্যাগ করে পাড়ি দিলেন অমৃতধামে।
উপসংহার :
বিভূতিভূষণ চলে গেছেন অনেকদিন। কিন্তু আজও তাঁর জনপ্রিয়তা অম্লান। শুধু তাই নয়, তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। তাঁর লেখায় পরিশুদ্ধ বিবেকের প্রকাশ। ‘পথের পাঁচালী’ তাঁর অমর সৃষ্টি। বিভূতিভূষণ তাঁর সৃষ্টির জন্য, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার জন্য এবং কিশোর রচনার জন্য জন্মশতবর্ষ পরেও বাংলা পাঠকের হৃদয়ে সহজেই স্থান করে আছেন।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ, (২) বিভূতিভূষণ ও বাংলা সাহিত্য।
গ্রন্থাগার রচনা
ভূমিকা :
গ্রন্থাগার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ত্রিবেণি সংগম। মানুষের মনের নানান জিজ্ঞাসা, তার সমাধান লিপিবদ্ধ থাকে গ্রন্থে। অজানা রহস্যের অনুসন্ধান, বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের অমূল্য সম্পদ সবই এই গ্রন্থের কারাগারে বন্দি। মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু কোনো ব্যক্তির পক্ষে বিশ্বভাণ্ডারের এই গ্রন্থ সংগ্রহ করা অসাধ্য। গ্রন্থসমূহ মানুষ যত্নে একত্রিত করে গড়ে তোলে গ্রন্থাগার।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা :
মানুষ বৃহৎ জগতের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। নিজেকে জানতে চায়, জানাতেও চায়। রচনা করে নানান গ্রন্থ। অতীত ইতিহাস বিধৃত থাকে, নতুন প্রজন্ম সেই গ্রন্থের স্পর্শে জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। গ্রন্থাগারই মানুষের একমাত্র সহায়ক। প্রাচীনকালের গ্রন্থাগার প্রাচীনকালে ছিল গুরুপরম্পরায় শিক্ষাদান। পরে তালপাতায়, ভূর্জপাতায়, পশুর চামড়ায়, তুলোট কাগজে মানুষ তার চিন্তাভাবনাগুলিকে ধরে রাখত। আরও পরে শিলালিপিতে খোদাই করে রাখা হত। তারপর আবিষ্কৃত হয় মুদ্রণযন্ত্র। প্রাচীন রোমেই সর্বসাধারণের জন্য প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। ভারতবর্ষের বুকে বৌদ্ধবিহারে, নালন্দা মহাবিহার ও বিক্রমশিলার গ্রন্থাগার ছিল অত্যন্ত বৃহৎ। সোমনাথ ও বারাণসীর গ্রন্থাগারও ছিল উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানের গ্রন্থাগার :
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বর্তমানে শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশি। ফলে আরও বেশি করে গ্রন্থাগারের প্রয়োজন হওয়ায় নানান ধরনের গ্রন্থাগার তৈরি হয়েছে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোটো-বড়ো গ্রন্থাগার রয়েছেই। এগুলিতে মূলত শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন উপযোগী গ্রন্থ থাকে। কিন্তু বিদ্যালয়ের বাইরেও অগণিত মানুষ রয়েছে। তাই তাদের কাছে জ্ঞানভাণ্ডার পৌঁছে দিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগার। জাতীয় গ্রন্থাগার ছাড়াও রয়েছে গ্রামে গঞ্জে গ্রামীণ গ্রন্থাগার।
আধুনিক গ্রন্থাগারের ভূমিকা :
গ্রন্থাগার মানুষকে জ্ঞানের আলো দেয়। গ্রন্থাগার মনের অন্ধকার দূর করার সহায়ক। আধুনিক গ্রন্থাগারের একটি বড়ো কাজ হল রেফারেন্স সার্ভিস’। এখানে পাঠকগণ তাদের মনের কথা বলে প্রয়োজনমতো পুস্তক সংগ্রহ করতে পারে। বিভাগীয় কর্মীরা পাঠকদের সেইভাবে সাহায্য করে। এ ছাড়াও এখন প্রদর্শনী, নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে বিষয়গত আলোচনা হয়ে থাকে, যাতে পাঠকবর্গ ভুলপথে পরিচালিত না হয়।
গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা :
গ্রন্থাগার যত বেশি সচল, যত বেশি মানুষের উপস্থিতি ঘটাতে পারে সেই গ্রন্থাগারটি তত বেশি সফল। এখানে গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা অত্যন্ত প্রবল। শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করতে হলে, তাদের মনের কাছে পৌঁছে যেতে হলে গ্রন্থাগারিককে অমায়িক হতে হবে, সন্ত্বনয় ও ছাত্রস্বার্থরক্ষাকারী এক ব্যক্তিরূপে নিজেকে তুলে ধরতে হবে।
উপসংহার :
গ্রন্থাগার মানুষের জীবনসহায়ক। অন্ধ যেমন যষ্টিকে আশ্রয় করে চলে, তেমন জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীরাও গ্রন্থাগারকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলে। মননশীল লেখক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “লাইব্রেরি হাসপাতালের চেয়ে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) গ্রন্থাগার ও শিক্ষাবিস্তার, (২) মানবসভ্যতা ও গ্রন্থাগার।
আরও পড়ুন – সার্ভে পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা