বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ
“কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাঁই,
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু
পরকে করিলে ভাই।”
– রবীন্দ্রনাথ
ভূমিকা
একবিংশ শতাব্দীর দুয়ারে সভ্যতার যে রথ এসে দাঁড়িয়েছে, তার চাকার গতি, শক্তি অমিত। এ গতি মানুষেরই বহু শতকের নিরলস সাধনার ফল। উন্নত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, কর্মনিষ্ঠ মানুষ তার সভ্যতাকে হিমালয়ের শীর্ষে স্থাপন করেছে। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অবদানে। বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান হল বিমূর্ত জ্ঞান। বিভিন্ন প্রযুক্তির মধ্যে যার বাস্তব রূপায়ণ ঘটে। উন্নত সভ্যতার মূল চাবিকাঠিই বিজ্ঞান।
মানবকল্যাণে বিজ্ঞান
বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয় ভোরের চায়ের পেয়ালা দিয়ে। খবরের কাগজ, টিভির সংবাদ ও নিত্যনতুন রংবাহারি অনুষ্ঠান, ওয়াশিং মেশিন, অতিথির উম্বু অভ্যর্থনার জন্য ফ্রিজের সামগ্রী — সব কিছুই হাতের সামনে। বিজ্ঞানের জাদু স্পর্শে বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন, মেট্রোরেল, চক্ররেল, বাস, ট্যাক্সি, অটো, টোটো সবই প্রস্তুত মানুষকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অতীতের গোরুর টানা লাঙলের পরিবর্তে রয়েছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ও শস্য উৎপাদনের কতরকমের রাসায়নিক সার। তৈরি হয়েছে ডিপ টিউবওয়েল, নদীর বুকে বাঁধ। এর জন্য অসময়ে জলকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে রুক্ষ, শুষ্ক জমিকে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে। বিদ্যুতের আলো রাতকে দিনে পরিণত করেছে। রয়েছে বিনোদনের জন্য টিভি, রেডিয়ো, সিনেমা হল প্রভৃতি। বিজ্ঞানই মানুষের সুস্থ ও দীর্ঘজীবন দানের সহায়ক। আবিষ্কার হয়েছে পেনিসিলিন। হয়েছে আরও জীবনদায়ী ওষুধ। অনেক কঠিন অস্ত্রোপচার বিজ্ঞানের অবদানেই সম্ভব ও সহজতর হয়েছে। মানুষের বন্ধু বিজ্ঞানই।
বিজ্ঞানের অমানবিক প্রয়োগ
বিজ্ঞান যেমন মানুষকে অমিত শক্তির অধিকারী করেছে, তেমনি কিছু মানুষের অমানবিক প্রয়োগে আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। তাই একদিন হিরোশিমা, নাগাসাকির সূর্যকরোজ্জ্বল আকাশ পরমাণু বোমার আগুনে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। হারিয়ে গিয়েছিল শত শত প্রাণস্পন্দন। মুহূর্তে শ্মশান হয়ে গিয়েছিল মুখর নগরী দুটি। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ হল স্তম্ভিত, নির্বাক। এর কুফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। যে বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ স্বর্গরাজ্য উপহার দিয়েছে, তারই সাহায্যে মানুষ ধ্বংসলীলায় মত্ত এ চিত্র প্রতিনিয়তই চলছে। চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনা কিংবা ভূপালের গ্যাস দুর্ঘটনা স্বার্থান্বেষী মানুষের বিজ্ঞানকে কুপথে পরিচালনা করার ফল। এ ছাড়া পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা পরিবেশকে যথেষ্ট দূষিত করেছে। মানুষের সুখী গৃহকোণে ফ্রিজ, এয়ারকুলার যে পরিমাণে গ্যাস নির্গত করছে তার ফলে পৃথিবীর উপরিভাগের বাতাসের স্তর নষ্ট হয়ে গিয়ে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি সরাসরি পড়ছে আমাদের ওপর যার ফলশ্রুতি হিসেবে মানুষের ত্বকে দেখা দিচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার।
বিজ্ঞানের রূপ
সুন্দর এ পৃথিবীতে মৃত্যুর যে তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে তার জন্য দায়ী কে? দায়ী কিছু ক্ষমতালিপ্সু, স্বার্থপর, যুদ্ধপিপাসু মানুষ। মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ হয়েও মানুষকে আঘাত হানতে কোনোরূপ দ্বিধাবোধ করেনি। বিজ্ঞান মানুষকে পার্থিব ঐশ্বর্যের চাবিকাঠি উপহার দিয়েছে। কল্যাণরূপেই তো বিজ্ঞান মানুষের কাছে উপস্থিত। বিজ্ঞানের অপব্যবহারেই মানুষ আজ ধ্বংসের তাণ্ডবলীলায় মত্ত।
উপসংহার
বিজ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অকৃত্রিম বন্ধু। বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আবেগহীন মানুষ যন্ত্রেরই সেবক হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের অপব্যবহার আমাদের বন্ধ করতেই হবে। কঠোর হতে হবে সরকারকে। সর্বোপরি প্রয়োজন মানুষের সচেতনতাবোধের জাগরণ।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) মানবকল্যাণে বিজ্ঞান, (২) বিজ্ঞানের লক্ষ্য যুদ্ধ নয় শান্তি।
আরও পড়ুন – নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা