“সংস্কৃতি জীবনের সঙ্গে জড়িত সেইজন্য এর চরম – রূপ কোনও একসময়ে চিরকালের জন্য বলে দেওয়া যেতে পারে না। জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতা আর সংস্কৃতি গতিশীল ব্যাপার।’ –সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
ভূমিকা :
সংস্কৃতি হল জাতির সামগ্রিক পরিচয়পত্র। এর মধ্যে থাকে মার্জিত মানসিকতা। কোনো জাতি যখন শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-ভাস্কর্য-স্থাপত্য-আচার-অনুষ্ঠান-ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দার্শনিক ভাবনা – আধ্যাত্ম আকুতি নিয়ে সফল প্রকাশ ঘটায়, সেটাই তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মধ্যেই জাতির সমদৃষ্টি, মৈত্রীবোধের প্রকাশ ঘটে। তাই সংস্কৃতি জাতির সর্ববিধ বিষয়ে সর্বাঙ্গীণ উন্নতির চরমতম পরিণাম ফল।
বাংলার সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ :
বাংলার সংস্কৃতি সুপ্রাচীন। আর্য অভ্যুদয়ের বহু পূর্বেই এর উদ্ভব ও বিকাশ। বাংলার সংস্কৃতির প্রথম ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করেছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠী। তারপর এসেছে দ্রাবিড়; আর্যজাতি, মিশ্রণ ঘটল বিভিন্ন ভাষাভাষীর। বলা যায় অষ্টম শতাব্দী থেকে বাঙালির সংস্কৃতির সূচনা ঘটে।
নিসর্গ, গ্রাম ও বঙ্গ-সংস্কৃতি :
বাংলার সংস্কৃতির প্রাণভূমি ছিল গ্রাম। বাংলার গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি এসবই সংস্কৃতিকে লালন ও বর্ধন করেছে। ষড়ঋতুর যে বিচিত্র লীলা তা নৈসর্গিক চিত্রকে অভিনব করে তুলেছে। দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ রূপময়তা। প্রকৃতির ধ্বংস ও সৃষ্টির খেলা, রয়েছে জীবন-মরণের দোলা। মানুষ তার মধ্য দিয়েই জীবন অতিবাহিত করে চলেছে। প্রকৃতির বিচিত্র মহিমায় বাংলার সংস্কৃতি পুষ্ট।
বাংলার সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য :
বাংলার সংস্কৃতিতে রয়েছে সবার সংযুক্তি। বাঙালি কাউকে দূরে ঠেলে দেয়নি। এটাই বাঙালির স্বাতন্ত্র্য। অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্য তার সংস্কৃতির সৃষ্টি ও বিকাশের মূলে। তাই বাঙালি বৈদিক যাগযজ্ঞ, অনার্যদের ক্রিয়াকর্ম, আবার ইসলামদের ভ্রাতৃত্ববোধ, বৈষুবদের প্রেমগীতি সব কিছুই নিজেদের সম্পদ বলে গ্রহণ করেছে।
ধর্ম ও সংস্কৃতি :
ধর্ম সংস্কৃতির অন্যতম বস্তু। বাঙালি সংস্কৃতির মূলে রয়েছে গভীর ধর্মবোধ। ধর্ম মানবসমাজে এক অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই বাংলার সংস্কৃতির বিকাশ এই ধর্মকে আশ্রয় করেই এগিয়েছে। মিশে গেছে লৌকিক ও পৌরাণিক ধর্মাচরণ। মানুষও লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীদের সামনে রেখেই মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করেছে। সৃষ্টি হয়েছে অনেক কাহিনি-কাব্য।
বঙ্গ-সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য :
বাংলার লোকসাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি মন গভীরভাবে নিবিষ্ট। বাঙালির মনে মঙ্গলকাব্য, ময়নামতীর গান, বাউল, কীর্তন, কবিগান, ভাটিয়ালি কী নেই! লোকসাহিত্যের চরিত্রগুলি বাঙালি মনের মনিকোঠায় বিধৃত হয়ে রয়েছে। যেমন • ফুল্লরা, মেনকা, উমা, চন্দ্রধর, সনকা, বেহুলা, লখিন্দর প্রভৃতি। এরাই যেন বাঙালির প্রাণ।
কারুশিল্প ও বঙ্গসংস্কৃতি :
বাংলার সংস্কৃতিতে কারু শিল্পের যেমন পট-অঙ্কন, মৃৎশিল্প, চালচিত্র, আলপনা প্রভৃতির এক অনবদ্য স্থান রয়েছে। কৃয়নগরের মাটির পুতুল, কালীঘাটের পটশিল্পের সঙ্গে বঙ্গসংস্কৃতি একাত্ম।
বঙ্গসংস্কৃতি ও আধুনিক যুগ :
আধুনিক যুগের সূত্রপাত ইংরেজদের আগমনে। সূচনা হয় নতুন ভাবধারার। নবজাগরণের সূত্রপাতে শিক্ষায়, সমাজসংস্কারে নতুন উদ্দীপনা আসে। বহু মনীষীর সংস্পর্শে সংস্কৃতি নব রূপলাভ করে। তবে দেশ দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় ধর্মান্ধতা মাথাচাড়া দেওয়ায় সাম্প্রদায়িকতা বাংলার সংস্কৃতিকে আঘাত করে।
উপসংহার :
তবু বাঙালি জাতি মন্বন্তরে মরে না। বঙ্গলক্ষ্মীর করুণাধারা রয়েছে। সমস্ত রকম বাধা কাটিয়ে উঠবেই। ঘুচে যাবে সংকীর্ণতা। অরুণোদয় ঘটবে। বঙ্গসংস্কৃতি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে এবং মানুষকে পথ দেখাবে।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) বাংলার সংস্কৃতির রূপ।