বাংলার মেলা রচনা

বাংলার মেলা রচনা
“মিলনের মধ্যে যে সত্য তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে, তাহা আনন্দ, তাহা রসস্বরূপ, তাহা প্রেম।” -রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা : 

মেলা হল মিলনের ক্ষেত্র। মিলনের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়; উপলব্ধি করে শ্বাশ্বত সত্যকে। বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মেলার সম্পর্ক গভীর। গ্রাম-বাংলার উদার, নিসর্গ পটভূমিকায় এই যে মিলনের মেলা, এ শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন ঘটায় না, বরং অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানকে মিশিয়ে দেয়।

লৌকিক দেবতা ও মেলা : 

ধর্মের সঙ্গে মানুষের মনের এক গভীর যোগসূত্রতা। বিভিন্ন গ্রামে, অঞ্চলে গ্রামীণ দেবদেবীকে কেন্দ্র করে উৎসব হয়। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী, ওলাবিবি, পীর এমনি কত লৌকিক দেবদেবী গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে জড়িত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই মেলায় উপস্থিত হয়। আনন্দ জোয়ারে মেতে ওঠে।

ধর্মীয় মেলা : 

মেলা বাংলার এক নিজস্ব সম্পদ। দেবদেবী আশ্রিত মেলা ছাড়াও রয়েছে ধর্মীয় মেলা। সাগরের গঙ্গাসাগর মেলাকে প্রয়াগ বা হরিদ্বারের কুম্ভমেলা, শ্রীক্ষেত্রের রথের মেলার সঙ্গে তুলনা করা চলে। মকর সংক্রান্তির পুণ্য প্রভাতে সাগরে পুণ্য স্নান করে ভক্তবৎসল মানুষ। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের মানুষ এই মেলায় উপস্থিত হয়। নবদ্বীপে ও শান্তিপুরে রাসের মেলা খুব জমজমাটভাবে বসে। শ্রীরামপুরে মাহেশের রথের মেলা খুব প্রাচীন। তবে রথযাত্রা উপলক্ষ্যে নানান জায়গায় ছোটো-বড়ো অনেক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার মেলা, বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে বিশালাক্ষী মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলা, চড়কের মেলা, তারকেশ্বরে গাজন মেলা খুবই খ্যাত।

মনীষী স্মরণ মেলা : 

পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু মানুষ এসেছেন যাঁরা চিরস্মরণীয়, বরণীয় হয়ে রয়েছেন। বাঙালিরা সেই সমস্ত বরেণ্য মানুষদের নিয়ে মেলার অনুষ্ঠান করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। যেমন কেঁদুলিতে জয়দেবের মেলা, ফুলিয়ায় কবি কৃত্তিবাসের মেলা, ছাতনায় চণ্ডীদাসের মেলা প্রভৃতি।

পৌষমেলা : 

শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা খুবই খ্যাত। এই মেলার নেপথ্যে একটি ঘটনাও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫০ বঙ্গাব্দে ৭ পৌষ ব্রাত্ম সমাজে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনার স্মরণেই ১৩০২ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ শান্তিনিকেতনে এই পৌষমেলার সূচনা হয়। এই মেলায় বীরভূমের লোকসংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। বাউল গান, পোড়া মাটির খেলনা, বাঁশের ও তালপাতার রকমারি জিনিস মেলার আকর্ষণ। সাঁওতাল আদিবাসীদের অংশগ্রহণ, বিদেশি পর্যটকদের উপস্থিতিতে মেলা উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

মেলার সাধারণ চিত্র : 

মেলা মানেই বহু মানুষের একত্র আগমন। ফলে ভিড়, হট্টগোল, ঠেলাঠেলি, হরেকরকম বাঁশির আওয়াজ, নানা রকম পোশাক, খাওয়ার দোকান, রকমারি জিনিসের দোকান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নাগরদোলা, ম্যাজিক, পুতুলনাচ প্রভৃতির মতো উপভোগ্য মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা। নানা রকম চিত্র এই গ্রামীণ মেলায় দেখা যায় ।

আধুনিক মেলা : 

জীবন-জগৎ পরিবর্তনশীল। মেলারও ঘটেছে নানা পরিবর্তন। আধুনিক জীবন নগরকেন্দ্রিক। তাই শহরে প্রচলিত হয়েছে বাণিজ্য মেলা, শিল্প মেলা, বই মেলা ইত্যাদি আরও অনেক রকমের মেলা। এগুলি সবই বাংলার সংস্কৃতির এক রূপ।

উপসংহার : 

মেলা লোকসংস্কৃতির পরিচয়বাহী। মেলার লোক সাধারণভাবে যেমন আনন্দ উপভোগ করে তেমনই মেলার সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। মেলার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার আশ্বাস পাওয়া যায়। মেলাতে রয়েছে সৃজনশীলতা ও প্রাণশক্তির স্পর্শ ।

Leave a Comment