“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ! দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী মানুষের কত কীর্তি কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, কত না অজানা জীবন, কত না অপরিচিত তরু রয়ে গেল অগোচরে।” –রবীন্দ্রনাথ
ভূমিকা :
‘ভ্রমণ’ শব্দ কানে প্রবেশ করলেই মানুষের মনে শিহরন জাগে। মন যে কোথায় হারিয়ে যায়। ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চায় মন। এ এক অদ্ভুত টান। একদিকে রহস্যময়ী বিশ্বপ্রকৃতির দুর্বার আকর্ষণ, অন্যদিকে অন্তরের পিপাসা। এ-দুয়ের মিলনে প্রকৃতিও সার্থক; মানুষও পায় পূর্ণতা। তাইতো মানুষ ঘর ছেড়ে বহু অর্থ ব্যয় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পাড়ি দেয় দুর্গম পর্বতে, নিবিড় গহনে, ধুধু-মরুপ্রান্তরে।
চলিম্বুতাই জীবন :
এগিয়ে চলাই জীবনের ধর্ম। ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।’ উপনিষদেও পাওয়া যায় ‘চরৈবেতি, চরৈবেতি’। মুক্তির আনন্দে মেতে উঠতে চায় মন। অদেখাকে দেখা, অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানতে হলে মুক্তিপাগল মন ছুটে চলে। ছুটে চলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে।
“সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া।” তাই প্রকৃতির বিচিত্র চিত্রশালে দেশ-দেশান্তরে মন তার ঐশ্বর্য খুঁজে চলে।
দেশভ্রমণ ও শিক্ষা :
দেশভ্রমণের সঙ্গে শিক্ষার যোগ অত্যন্ত নিবিড়। পুথির জ্ঞান আমাদের মনে পূর্ণতা দেয় না— প্রয়োজন দর্শন ও উপলব্ধি। তাই পুথিগত বিদ্যার সঙ্গে বাস্তবের যোগসূত্রতা ঘটাতে হবে। এই যোগসূত্রতার পথ হল দেশভ্রমণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানান ভাষা-ভাষীর মানুষ। তাদের জীবনযাত্রা, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় আচরণ ভিন্ন ভিন্ন। দেশভ্রমণে সেই সমস্ত মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বইয়ে পড়া অজন্তা ইলোরার কালজয়ী ভাস্কর্যের শিল্পবৈভব একমাত্র প্রত্যক্ষ দর্শনেই উপলব্ধি করা যায়। নালন্দা তক্ষশিলার ধ্বংসস্তূপে গিয়ে দাঁড়ালে উপলব্ধি করা যাবে প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার মর্মরূপ। তখনই দেশভ্রমণ আমাদের জীবনকে করে তোলে অর্থময় ও পরিপূর্ণ। সে-কারণেই দেশভ্রমণ শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
দেশভ্রমণের গুরুত্ব :
যুগের পরিবর্তনে মানুষের রুচি ও চাহিদার ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। ছকবাঁধা জীবন থেকে প্রয়োজনের তাগিদ কাটিয়ে দেশভ্রমণের নেশা মানুষকে টেনে নিয়ে গেছে প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে ব্যবধান দূরীভূত হয়ে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক। তীর্থস্থানগুলো তো সেই অনন্ত মহিমারই পাদপীঠ। বহু মানুষের পবিত্র স্পর্শে তার হৃদয় ভরে ওঠে আনন্দে। দেশভ্রমণে ঘটে সংস্কৃতির আদানপ্রদান। শিক্ষা-প্রযুক্তিবিদ্যারও আদানপ্রদান ঘটে। এ ছাড়াও জাতীয় ক্ষেত্রে আয় বৃদ্ধি, রাজনৈতিক কোলাহল, সন্দেহ-বিদ্বেষের পরিবেশ প্রশমিত হয়।
পর্যটকদের অবদান :
ভারতভূমি পর্যটকদের কাছে স্বর্গবিশেষ। দুর্বার আকর্ষণ রয়েছে সৌন্দর্যশোভিত দেবতাত্মা হিমালয়ের; ভূস্বর্গ কাশ্মীর থেকে তরঙ্গোত্থিত মহাসিন্ধু; তথা আতঙ্কপাণ্ডুর মরুভূমির পাশাপাশি ভয়ংকর সুন্দর সুন্দরবনের গহন অরণ্যভূমির আকর্ষণও মানুষের চিত্তকে উদ্বেল করে তোলে। বর্তমানে দেশভ্রমণের সুবিধা : সুদূর অতীতে দেশভ্রমণ ছিল কষ্টসাধ্য, বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার আনুকূল্যে তা দূরীভূত। বিভিন্ন টুরিস্ট ব্যুরো, ট্রাভেল এজেন্সি থাকায় মানুষ সহজে ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে পারছে। বেড়েছে ভ্রমণপিপাসুদের সংখ্যা।
উপসংহার :
শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করে। ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান সুদৃঢ় হয়, মনের প্রসারণ ঘটে ও চিত্তের প্রশান্তি ঘটে। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি; পৃথিবীর পথে। সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি।’
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) দেশভ্রমণে আনন্দ ও শিক্ষা, (২) দেশভ্রমণ ও শিক্ষা।