ভূমিকা :
মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে, কালের নিয়মে একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। হারিয়ে যায় পরিবার পরিজন মানুষের মন থেকে। আবার দেখা যায়, কিছু মানুষ পৃথিবীতে এসেছিলেন বহু আগে, তাঁরা কিন্তু আলাপে- আলোচনায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সদা বিরাজমান। মৃত্যুকে জয় করে হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী। অর্থ দিয়ে নয়, শুধু কর্ম, প্রজ্ঞা দিয়ে মানুষের হৃদয়ে চির ঠাঁই করে নিয়েছেন। এমনই এক বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী হলেন মেঘনাদ সাহা।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর ঢাকা শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরের এক অখ্যাত গণ্ডগ্রাম শ্যাওড়াতলিতে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। পিতা জগন্নাথ সাহা ও মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী। বলিয়াদি বাজারে ছোটো একটি দোকান চালিয়ে চলে সংসার। তাই বড়োভাই ও মেজো ভাই অর্থাভাবে পড়াশুনো বেশিদূর করতে পারেনি।
শিক্ষা :
অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মেঘনাদ পাঠ শুরু করেন গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বই তাঁর বন্ধু। নিষ্ঠা সহকারে চলে অধ্যয়ন। মাঝে মঝে বসেন দোকানে। প্রাইমারির পাঠ শেষ হলে বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদা জয়নাথের চেষ্টায় প্রায় সাত মাইল দূরে শিমুলিয়া গ্রামে অনন্তকুমার দাস নামে একজন ডাক্তারের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু হয়। এটা ছিল মিডল স্কুলের পাঠ। পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং বৃত্তি পান। মাসিক চার টাকা বৃত্তি নিয়ে ঢাকা শহরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পাঠ শুরু করেন। কিন্তু ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে মেঘনাদের নামটি জড়িয়ে যায়। সরকারি বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পূর্ববঙ্গের মধ্যে তিনি হন প্রথম। ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষায় তৃতীয় হন। গণিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এম.এস.সিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
গবেষণা ও কৃতিত্ব :
কর্মজীবনের শুরুতে কর্মজীবন মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ের অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন। তবে পরে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে বদলি হন। মাত্র তেইশ বছর বয়সে ডি.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৯ -এ পান প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি। এই বৃত্তি পান তাঁর ‘অন হার্ভার্ড ক্লাসিফিকেশন অব স্ট্রেলার স্পোকট্রন’ গবেষণা কার্যের জন্য। পাড়ি দেন বিদেশে, নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। পরিচয় হয় আইনস্টাইন, ম্যাক্স, প্ল্যাঙ্ক, প্রোটিয়ান প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। —
আবিস্কার ও অবদান :
বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘তাপ আয়নন তত্ত্ব —এক অমর সৃষ্টি। বর্ণালির রহস্য সমাধানে তাঁর ‘তাপ আয়নন’ সূত্র বহু রহস্যের সমাধান করেছে। বিজ্ঞানকে তিনি সমৃদ্ধ ভারত গঠনের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, পঞ্জিকা সংস্কার, বিজ্ঞান আকাদেমি গঠন, নিউক্লিয়ার এনার্জির প্রসার, শিক্ষা কমিশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস কর্মপ্রয়াস চিরস্মরণীয়। বাংলার দুর্দশার কথা ভেবে দামোদর প্রকল্পে তাঁর অবদান স্মরণীয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা, জলবিদ্যুৎ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর পথনির্দেশ এক নবদিগন্ত উন্মোচনের পরিচায়ক।
উপসংহার :
মেঘনাদ সাহা ভারতরত্ন, দেশের গর্ব। দেশ গঠনের জন্য তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লোকসভার সদস্যও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ধর্মীয় গোড়ামি তাঁর ছিল না। বিজ্ঞানকে আশ্রয় করেই তাঁর জীবন পরিচালনা ছিল বলেই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অনুসন্ধান করেছিলেন তিনি জীবনভোর।