উন্নয়ন বনাম পরিবেশ রচনা

উন্নয়ন বনাম পরিবেশ  রচনা

উন্নয়ন বনাম পরিবেশ

‘তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে, কেমন করে সইব! বাতাস আলো গেল মরে, একি রে দুর্দৈব!” 
-রবীন্দ্রনাথ

ভূমিকা : 

আলো বাতাস মানুষের প্রাণ। জীবজগৎ, প্রাণীজগৎ এরই স্পর্শে বেঁচে থাকে। সেই আলো বাতাসের মৃত্যু এলে জীবকুল প্রাণীকুলের অস্তিত্বও নিঃশেষ হয়ে যাবে। এগুলিই মানুষের পরিবেশ। বিজ্ঞান প্রযুক্তির হাত ধরে সভ্যতার অগ্রগতি এখন অভাবনীয়। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, জীবনচর্চা সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নের ছোঁয়া। কিন্তু উন্নয়ন মানুষকে কতটা বাঁচতে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে বা পরিবেশকে কতটা সুস্থ রাখতে সাহায্য করছে তা নিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানী, পণ্ডিতমহল চিন্তিত।

উন্নয়ন ও পরিবেশ : 

আকাশ, বাতাস, মাটি, জল, গ্রহ, উদ্ভিদ, প্রাণী নিয়ে এই বিশাল জগৎ। মানুষ এর একটা ক্ষুদ্র অংশ। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মানুষের উন্নতি তাই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে সম্ভব নয়। পরিবেশকে বাঁচিয়ে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক উন্নয়ন। পরিবেশ শুধু প্রকৃতিগত নয়, সমাজবদ্ধ মানুষ; মানুষের মানসিক সুস্থতা সব নিয়েই পরিবেশ। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের যোগসূত্রতা খুবই গভীর ও একাত্ম।

কৃষির উন্নয়নে পরিবেশের প্রভাব : 

ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। শতকরা ৭৪ভাগ মানুষ কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে কৃষির সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। গৃহপালিত পশুপালন, মাছচাষ, কৃষি কাজ করে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড বীজ, রাসায়নিক ও জৈব সার, কীটনাশক বিষ, উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা ও পরিচর্যা – কৃষিজ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ালেও – বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রয়োগে পরিবেশের ওপর খারাপ প্রভাব পড়েছে। বন্ধুপোকার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে শত্ৰুপোকার বৃদ্ধি ঘটেছে। ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমেছে। পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ বেড়েছে। জমি আম্লিক ও অনুর্বরা হয়েছে। কৃষিতে ব্যবহৃত কীট-বিষ খাদ্যের মাধ্যমে শরীরের ক্ষতি করছে। খাদ্যের স্বয়ম্ভরতা বাড়লে বা কৃষির উন্নয়ন হলেও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

শিল্পের উন্নয়নে পরিবেশের প্রভাব : 

উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে শিল্পের গুরুত্ব সর্বাধিক। হয়েছে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। ক্ষুদ্র মাঝারি ভারী শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বেকার সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতি হয়ে উঠছে বিষময়। কলকারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া – CO2 এবং বহু বিষাক্ত গ্যাসীয় পদার্থ বায়ুতে, বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে, জলে মিশছে। প্লাস্টিক, অ্যাসিড, কাগজ, সিমেন্ট কারখানা প্রভূত দূষণ সৃষ্টি করে। অব্যবহার্য শিল্পসামগ্রী, বর্জ্য পদার্থ দূষণের অন্যতম কারণ।

উপকূলীয় পরিবেশের প্রভাব : 

ভারতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র উপকূলীয় তটভূমি। জাহাজ থেকে নির্গত তেল সমুদ্রের জীবসম্পদের ক্ষতিসাধন করছে। মাছ ধরার ট্রলার সমুদ্রের জীবন পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে। কলকারখানার রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রের জলে মিশে যাওয়ায় জেলিফিস, ডলফিন মারা যাচ্ছে এবং পেঙ্গুইন, সিলমাছ, তিমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাগদা চিংড়ির ‘মীন’ ধরার জন্য ছোটোমাছ, কাঁকড়া বা সমুদ্রের প্রাণী নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।

পার্বত্যভূমির পরিবেশের প্রভাব : 

হিমালয় পর্বত ভারতের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ঘটায় এবং শীতের প্রকোপ কমায়। বর্তমানে পাহাড়ে জনবসতি বাড়ায় অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে। কাঠের ঘরের পরিবর্তে পাকা বাড়ি হচ্ছে ফলে ধস নামছে। বাতাস বিশুদ্ধ রাখার জন্য বনভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বায়ুদূষণে প্রাকৃতিক ও মানবিক ক্রিয়ার প্রভাব : 

সমগ্র জীবজগৎকে ঘিরে রেখেছে বায়ুমণ্ডল। সভ্যতার অগ্রগতিতে শিল্পায়ন বেড়েছে, পাশাপাশি বায়ুদূষণ বেড়েছে। দাবাগ্নি, আগ্নেয়গিরি, মৃত জীবজন্তুর পচনের মতো প্রাকৃতিক উৎসগুলির সঙ্গে মানুষের সৃষ্টি শিল্প, যন্ত্রযানের ধোঁয়া, কৃষিকাজ, বনভূমি ধ্বংস ও বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়েছে।

উপসংহার : 

বাঁচা ও বেড়ে ওঠা মানুষের ধর্ম। উন্নয়নও মানুষের লক্ষ্য; তবে পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। সমস্যা কী হতে পারে তার সমাধানের পথও ভাবতে হবে। পরিবেশকে বাঁচিয়ে উন্নয়নই হবে একমাত্র লক্ষ্য।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক, (২) মানবসভ্যতার উন্নয়নে পরিবেশের প্রভাব।

Leave a Comment