আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষের বিভিন্ন মহাদেশে যাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। |
ভূমিকা :
আদিম মানুষ খাদ্য ও অনুকূল আবহাওয়ার সন্ধানে আফ্রিকা থেকে অজানা ভৌগোলিক ভূখণ্ডের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশীয় ভূখণ্ডে তারা ছড়িয়ে পড়ে। আদিম মানুষের আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অন্যান্য মহাদেশের ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে পরিযান (Migration) বলে।
পরিযানের পদ্ধতি :
দুটি পদ্ধতিতে আফ্রিকার আদিম মানব বিভিন্ন স্থানে যাত্রা করেছিল—
i. স্থলপথে :
স্থলপথে আফ্রিকার মানুষ মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত স্থলভাগের উপর দিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
ii. বরফের সমুদ্রের পথে :
তুষার যুগে সমুদ্রের জল বরফে পরিণত হলে সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন মহাদেশগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। এই বরফের উপর হেঁটে আদিম মানুষ ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাতে পৌঁছোয়।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিযান :
আফ্রিকার আদিম মানুষের দুটি বিশেষ পরিযান গুরুত্বপূর্ণ— i. প্রথম পরিযান, ii. দ্বিতীয় পরিযান।
i. প্রথম পরিযান :
খাদ্য সংগ্রহ ও অনুকূল আবহাওয়ার সন্ধানে হোমোইরেক্টাস প্রজাতির একটি মানবগোষ্ঠী সর্বপ্রথম জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে আফ্রিকার নিকটবর্তী উয় অঞ্চলে যাত্রা করে। এই ঘটনা আফ্রিকা থেকে প্রথম পরিযান নামে পরিচিত। সি স্ট্রিংগার (C. Stringer) এবং পি এন্ড্রুজ (P. Andrews) বলেন যে প্রথম পরিযানের 5 লক্ষ বছর পর আদিম মানব ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এদের বংশধররাই আজ থেকে আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে চিন, জাভাসহ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করত।
ii. দ্বিতীয় পরিযান :
আজ থেকে 1 লক্ষ 30 হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে হোমোস্যাপিয়েন্স অর্থাৎ আধুনিক মানুষের একটি বড়ো অংশ তীব্র ঠান্ডার কারণে বহির্বিশ্বের উদ্দেশে যাত্রা করে। এই ঘটনা দ্বিতীয় পরিযান নামে পরিচিত। এরপর থেকে দীর্ঘকাল ধরে হোমোস্যাপিয়েন্সদের আফ্রিকা থেকে পরিযান ঘটে।
বিভিন্ন মহাদেশে পরিযান :
আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহাদেশীয় ভূখণ্ডে আদিম মানুষের পরিযান ঘটে। এই পরিযানগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—
ইউরোপে যাত্রা :
আফ্রিকা মহাদেশ ত্যাগ করে আদিম মানুষ প্রথমে পৌঁছেছিল নিকটবর্তী ইউরোপীয় ভূখণ্ডে। আদিম মানুষ দুটি পথে ইউরোপে পৌঁছোয়।
i. স্থলপথে আরব ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে, কারণ, আফ্রিকা ও ইউরোপের সংযোগকারী ভূখণ্ড হল আরব উপদ্বীপ।
ii. আরবের দক্ষিণ পথ দিয়ে আদিম মানুষ ইউরোপে পৌঁছোয়। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি এই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
এশিয়াতে যাত্রা :
আফ্রিকার আদিম মানুষ প্রধানত দুটি ধারায় এশিয়া মহাদেশে পৌঁছেছিল।
i. ইউরোপের মধ্য দিয়ে : আদিম মানুষ আফ্রিকা থেকে প্রথমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর স্থলপথে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় পাড়ি দেয়। আদিম মানুষ এশিয়ার পশ্চিম অংশে প্রথমে পৌঁছোয়, পরে তারা চিন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যবদ্বীপে পৌঁছোয়।
ii. আরবের মধ্য দিয়ে : আদিম মানবের আর একটি গোষ্ঠী আরবের মধ্য দিয়ে ইউরেশিয়ার পথ ধরে ভারতে পৌঁছোয়। আই বি এম-এর গবেষক অজয় রেয়ুর তাঁর গবেষণাতে উল্লেখ করেছেন এশিয়া মহাদেশের চিন, ভারত মেসোপটেমিয়াতে আদিম মানুষের বসতি গড়ে ওঠে।
উত্তর আমেরিকাতে যাত্রা :
আনুমানিক ত্রিশ-চল্লিশ হাজার আগে পূর্ব এশিয়া থেকে আদিম মানুষ বরফের সমুদ্র অতিক্রম করে উত্তর আমেরিকাতে পৌঁছোয়। তুষার যুগে বেরিং প্রণালী ধরে এশিয়া থেকে আমেরিকার মাত্র 50 মাইল দূরত্বের জল বরফে পরিণত হলে আদিম মানুষ উত্তর আমেরিকাতে পৌঁছোয়। উযুগে বেরিং প্রণালীর বরফ গলে জলে পরিণত হলে মানুষ আর এই পথে আমেরিকাতে যেতে পারেনি।
দক্ষিণ আমেরিকাতে যাত্রা :
উত্তর আমেরিকা থেকে আদিম মানুষ দক্ষিণ আমেরিকাতে পৌঁছোয় । পানামা যোজকের বরফের উপর দিয়ে হেঁটে আদিম মানুষ দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে পা রাখে। এরপর ধারাবাহিক বিস্তারের মাধ্যমে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে। উষুযুগে সমুদ্রের বরফ জলে পরিণত হলে দক্ষিণ আমেরিকায় আদিম মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রভাব মুক্ত হয়ে তারা দক্ষিণ আমেরিকাতে সুপ্রাচীন মায়া ও আজটেক সভ্যতা গড়ে তোলে।
ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে যাত্রা :
তুষার যুগে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যবর্তী সমুদ্র বরফে পরিণত হয়। আজ থেকে প্রায় 30 হাজার বছর আগে আদিম মানুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বরফের সমুদ্রের উপর পায়ে হেঁটে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে পৌঁছোয়। তারপর ইন্দোনেশিয়া থেকে বরফের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছোয়।
মূল্যায়ন :
আফ্রিকার আদিম মানুষ খাদ্য সংগ্রহ ও অনুকূল আবহাওয়ার সন্ধানে আফ্রিকা ত্যাগ করে ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে আফ্রিকার সব প্রজাতির মানুষ আফ্রিকার মাটি ত্যাগ করেনি। কিছু কিছু প্রজাতি রয়ে গিয়েছিল। যেমন লুসি প্রজাতি।