হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বর্ণনা করো।

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বর্ণনা করো।
হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা বর্ণনা করো।

ভূমিকা : 

হরপ্পা সভ্যতা ভারতবর্ষের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পাবাসী এক উন্নত নাগরিক পরিবেশে আধুনিক জীবনযাপন করত। হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, কালিবঙ্গান, রুপার, লোথাল প্রভৃতি প্রতিটি কেন্দ্রেই উন্নত নাগরিক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার চিত্রটি পাওয়া যায়। 

দুর্গ : 

হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলির উঁচু স্থানে একটি দুর্গ থাকত। অনুমান করা হয় এই দুর্গে শাসকশ্রেণির মানুষ বসবাস করত। দুর্গটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত। দুর্গের বাইরে নীচু এলাকাতে সাধারণ মানুষ বসবাস করত।

রাস্তাঘাট : 

চওড়া প্রশস্ত, সোজা এবং পরিচ্ছন্ন রাজপথ  হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রধান রাস্তাগুলি 9 ফুট থেকে 40 ফুট চওড়া, পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল। একটি রাস্তা অপর রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হত। রাস্তার দু-ধারে আলোকস্তম্ভ, বাঁধানো ফুটপাথ ও ডাস্টবিন ছিল। পাথর, চুনসুরকি দিয়ে রাস্তাগুলি তৈরি করা হয়েছিল।

ঘরবাড়ি : 

হরপ্পা সভ্যতার বাড়িগুলি ছিল পোড়া ইটের তৈরি। অধিকাংশ বাড়িই দোতলা বা তিনতলা। প্রতিটি বাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রশস্ত উঠান, কুয়ো, স্নানাগার, সোকপিট প্রতিটি বাড়িতেই ছিল।

পয়ঃপ্রণালী : 

উন্নত পয়ঃপ্রণালী হরপ্পার নগর পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। রাস্তায় বাঁধানো ঢাকা দেওয়া নর্দমা ছিল। প্রতিটি বাড়ি থেকে ঢাকা দেওয়া নর্দমাগুলি বড়ো রাস্তার নর্দমাতে পড়ত। নর্দমাগুলিতে যাতে পলি পড়ে বা আবর্জনা পড়ে মজে না যায় তার জন্য ম্যানহোল দিয়ে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল। ঐতিহাসিক ব্যাসাম বলেন রোমান সভ্যতার আগে এত উন্নত পয়ঃপ্রণালী আর অন্য কোনো সভ্যতায় ছিল না।

স্নানাগার : 

মহেন-জো-দারোতে খননকার্য চালিয়ে একটি বিশাল স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। স্নানাগারটির আয়তন ছিল 180 ফুট × 108 ফুট। মধ্যবর্তী জলাশয়টির আয়তন ছিল দৈর্ঘ্যে 39 ফুট, প্রস্থে 23 ফুট ও গভীরতা ৪ ফুট। জলাশয়টির চারিদিকে ৪ ফুট উচ্চতার প্রাচীর ছিল। জলাশয়টিতে ওঠানামার জন্য সিঁড়ি ছিল। স্নানাগারটিতে জল ভরতি ও খালি করার ব্যবস্থা ছিল। স্নানাগারটির সামনে একটি বড়ো কুয়ো ছিল। নোংরা দূষিত জল বের করার জন্য নর্দমা ছিল। মর্টিমার হুইলার বলেছেন ধর্মীয় কারণেই স্নানাগারটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

শস্যাগার : 

হরপ্পা নগরে একটি কেন্দ্রীয় শস্যাগারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই শস্যাগারটির আয়তন ছিল 200 ফুট × 150 ফুট। একটি উঁচু মঞ্চের উপর এই শস্যাগারটি তৈরি করা হয়েছিল। শস্যাগারের সামনে একটি বিরাট চাতালে শস্য ঝাড়াই-মাড়াই হত। শস্যাগারের পাশেই শ্রমিকদের বাসস্থান ছিল। ব্যাসাম এই শস্যাগারটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

শক্তিশালী পৌরশাসন : 

হরপ্পা সভ্যতার পৌরশাসন ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। এই শাসকশ্রেণির চরিত্র ঠিক জানা যায় না। তবে কঠোর অনুশাসন ছিল। ফলে বন্যা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে শহরটি একবার ধ্বংস হলে পরবর্তীকালে তরত এক নকশাতেই পরবর্তী সবের নগর পরিকল্পনা অনুসারে গৃহ নির্মাণ করা হত।

মূল্যায়ন : 

হরপ্পা সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল নাগরিক সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর লক্ষ করেই। তার ফলে হরপ্পার অধিবাসীরা সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে পারত। হরপ্পার উন্নত নগর পরিকল্পনা সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির কাছে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে।

Leave a Comment