হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও

হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও
হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও

ভূমিকা : 

হরপ্পা সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম। খনন কার্যের ফলে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করেই এই প্রাচীন সভ্যতাটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের কথা জানতে পারি।

সামাজিক জীবন : 

হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে তাদের সমাজজীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হল-

শ্রেণিবিভক্ত সমাজ : 

হরপ্পা সভ্যতার সমাজ ছিল ওটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা—i. উচ্চবিত্ত, ii. মধ্যবিত্ত, iii. নিম্নবিত্ত।

উচ্চবিত্ত শ্রেণি : 

উচ্চবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল শাসক পুরোহিত শ্রেণি। সমাজে এই শ্রেণির প্রাধান্য সর্বাপেক্ষা বেশি ছিল।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি : 

বণিক, বুর্জোয়া, কারিগর ও যোদ্ধারা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক এ. এল. ব্যাসাম মনে করেন হরপ্পার সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা ছিল সুমের ও মিশর থেকে অনেক বেশি। হরপ্পা সভ্যতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক অবস্থা ছিল উন্নত

নিম্নবিত্ত শ্রেণি : 

দাস, ভৃত্য, দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অপেক্ষা নিম্নবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা কম ছিল।

উচ্চবিত্তের প্রাধান্য : 

হরপ্পা সভ্যতায় উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রাধান্য ছিল। তারা তামার অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির দরিদ্র মানুষদের শোষণ করত। সমাজের কঠোর পরিশ্রমের কাজ যেমন কৃষিকাজ ও রাস্তা নির্মাণ যথাক্রমে কৃষক ও শ্রমিকরা করত।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজ : 

হরপ্পা সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। হরপ্পার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত নারীমূর্তিগুলি দেখে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেছেন, সেখানে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রাধান্য বেশি ছিল।

খাদ্য : 

হরপ্পার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, খেজুর, পশুর মাংস, দুধ, আঙুর, আনারস প্রভৃতি। তামার বড়শির নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয় মাছ ও কচ্ছপ তাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পোশাক : 

হরপ্পাবাসী দু-খণ্ডবিশিষ্ট সুতি ও পশমের বস্ত্র ব্যবহার করত। দেহের ঊর্ধ্ব অংশে একটি অংশ এবং অপর অংশটি নিম্ন অংশে পরিধান করত।

অলংকার : 

হরপ্পার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অলংকার পরত। ধাতু ও পাথরের তৈরি হার, দুল, চুড়ি, বালা, আংটি, নূপূর, কোমরবন্ধ প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার করত। চোখে কাজল পরত, মেয়েরা মাথায় চুলের খোঁপা বাঁধত।

লিপি : 

হরপ্পা সভ্যতার মানুষ লিখতে পড়তে পারত। হরপ্পায় প্রাপ্ত বিভিন্ন সিল থেকে 270টি লিপি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই লিপিগুলির পাঠোদ্ধার আজও করা যায়নি।

বিনোদন : 

হরপ্পাবাসী অবসরে ষাঁড়ের লড়াই দেখত, পাশা খেলত, শিকার করত। অনেক সময় চিত্ত বিনোদনের জন্য নাচ, গান ও পাখির লড়াইয়ের আয়োজন হত।

অর্থনৈতিক জীবন : 

হরপ্পা সভ্যতার অর্থনীতি কৃষি ও পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল হলেও বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও বাণিজ্য হরপ্পার অর্থনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।

কৃষি : 

সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির উর্বর মাটি কৃষিকাজের অনুকূল ছিল। হরপ্পাবাসীর গম, যব, ধান, তিল, রাই, বাদাম, বাজরা, কলাই প্রভৃতি ছিল প্রধান কৃষিজাত ফসল।

সেচব্যবস্থা : 

এরা নদীতে বাঁধ দিয়ে বাঁধের জল সেচের কাজে ব্যবহার করত। কুয়োর জলও সেচের কাজে ব্যবহার করত।

কৃষি যন্ত্রপাতি : 

হরপ্পাবাসী চাষের মাটি তৈরি করার জন্য কাঠের তৈরি লাঙল, খেতের আগাছা পরিষ্কার করার জন্য নিড়ানি, ফসল কাটার জন্য কাস্তে প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত।

শস্যাগার : 

শস্য সংরক্ষিত করে রাখার জন্য হরপ্পা নগরীতে একটি বিশাল শস্যাগারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভূমিকা ছিল। বিভিন্ন কেন্দ্রে পশুর কঙ্কাল দেখে অনুমান করা হয় হরপ্পাবাসীর গৃহপালিত পশু ছিল গোরু, মহিষ,

পশুপালন : 

হরপ্পার অর্থনীতিতে পশুপালনের বিশেষ ভেড়া, ছাগল, কুকুর, উট প্রভৃতি প্রাণী। গোর ও মহিষকে তারা কৃষিকাজে ও পণ্য পরিবহণের কাজে লাগাত।

শিল্প : 

হরপ্পা সভ্যতায় মৃৎশিল্প, ধাতু শিল্প ও বয়ন শিল্পের প্রচলন ছিল। i. মৃৎশিল্প : কুমোরের চাকার সাহায্যে হরপ্পার মৃৎশিল্পীরা বেগুনি, বাদামি, লাল, হলুদ বিভিন্ন রং দিয়ে মাটির পাত্র তৈরি করত। পাত্রগুলিকে শক্ত করার জন্য পুড়িয়ে নিত। কলসি, জালা, থালা, ডেচকি, পেয়ালা ছাড়া ময়ূর, মাছ, নারীমূর্তি তৈরি করত। ii. ধাতু শিল্প : হরপ্পার ধাতুশিল্পীরা লোহার ব্যবহার না জানলেও তামা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে বর্শা, কুঠার, বল্লম, বড়শি, ছুঁচ তৈরি করত। এমনকি সোনা বা রুপার গহনাও তারা তৈরি করত। iii. বয়ন শিল্প : হরপ্পাবাসী সুতো ও পশম দিয়ে কাপড় বুনতে পারত। হরপ্পাবাসী সর্বপ্রথম সূতিবস্ত্র তৈরি করে।

বাণিজ্য : 

হরপ্পার বণিকরা স্থলপথে, জলপথে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সকল ধরনের বাণিজ্যে দক্ষ ছিল। পণি নামে বণিক শ্রেণি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। হরপ্পাবাসী ইরান, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান থেকে আমদানি করত সোনা, রুপা, টিন ও দামি পাথর, রপ্তানি করত সুতিবস্ত্র, তামা, হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য। গুজরাটের লোথাল ছিল হরপ্পাবাসীর প্রধান বন্দর। মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলিত না থাকার ফলে বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য চলত ।

Leave a Comment