গ্রিক পলিসগুলির উদ্ভবের কারণগুলি লেখো। পলিসগুলির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। |
গ্রিক পলিসগুলির উদ্ভবের কারণ :
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতকে গ্রিসের ধ্রুপদি যুগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্রগুলির উদ্ভব হয়। এই নগর-রাষ্ট্রগুলিকে ‘city state’ বা পলিস বলা হয়। এই পলিসগুলির উদ্ভবের পিছনে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল—
i. ভৌগোলিক কারণ :
গ্রিসের ভূখণ্ড পাহাড়-পর্বত ও সাগরের দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। এর ফলে এক-একটি দ্বীপে স্বাধীন ও সার্বভৌম পলিস গড়ে ওঠে। গ্রিসের এই ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা পলিসগুলি গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিল।
ii. অর্থনৈতিক কারণ :
ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার জন্য গ্রিসে পণ্য চলাচল ব্যাহত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতিটি স্থানীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি বিকশিত হয়। এই স্থানীয় অঞ্চলগুলিতে গ্রিকদের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলি উৎপাদিত হত। এই জন্য স্থানীয় অঞ্চলগুলিকে কেন্দ্র করেই পলিস গড়ে ওঠে।
iii. দুর্গ :
ডোরিয়ান বিজয়ের পর গ্রিকগণ বিদেশি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পাহাড়ের শীর্ষে দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে। এই দুর্গগুলি অক্টোপলিস নামে পরিচিত। এই দুর্গ অর্থাৎ অক্টোপলিসগুলি শাসকের বাসস্থান, ধর্মস্থান এবং জনগণের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়। এর ফলে অক্টোপলিসগুলি নগরে পরিণত হয়। আর এই নগরগুলিকে কেন্দ্র করে পলিস গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
iv. বাজার :
পণ্য কেনাবেচা ও আর্থিক লেনদেনের জন্য দুর্গের কাছে বাজার গড়ে ওঠে। এই বাজারগুলি মানুষের মেলামেশা ও ভাব বিনিময়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর ফলে বাজারগুলি ক্রমে ক্রমে নগরে পরিণত হয় এবং অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়।
গ্রিক ঐতিহ্য :
গ্রিকরা ছিল অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রিয় ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তারা স্বাধীনতা বলতে স্বেচ্ছাচার বুঝত না। তাদের মতে স্বাধীনতা হল একটি সম্প্রদায়ের সুনিয়ন্ত্রিত অস্তিত্ব। ছোটো ছোটো নগর-রাষ্ট্রকে তারা সমর্থন করত। তাদের মতে ছোটো রাষ্ট্র হল স্বাধীনতার প্রতীক। বড়ো রাষ্ট্রকে তারা পছন্দ করত না। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র বা পলিসগুলি গড়ে উঠে।
পলিসের বৈশিষ্ট্য :
গ্রিসের নগর-রাষ্ট্র বা পলিসগুলির বেশ কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ ক্ষ করা যায়। হল— এই বৈশিষ্ট্যগুলি
i. ক্ষুদ্র আয়তন :
গ্রিসের পলিসগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ক্ষুদ্র আয়তন। বর্তমানকালের আধুনিক রাষ্ট্রগুলির তুলনায় পলিসগুলির আয়তন ছিল খুবই ছোটো। কিয়স নামক ছোটো দ্বীপটিতে চারটি পলিস ছিল। করিন্থের আয়তন ছিল মাত্র 330 বর্গমাইল। এর থেকে পলিসের ক্ষুদ্রায়তন জানা যায়। ক্ষুদ্র আয়তন হওয়ার জন্য প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের কার্যে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারত।
ii. অল্প জনসংখ্যা :
অল্প জনসংখ্যা পলিসগুলির আরএকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। আয়তন ছোটো হওয়ার জন্য জনসংখ্যাও ছিল খুবই কম। আর্টিকা, এথেন্স, গিরাকিউজের মতো বড়ো পলিসের জনসংখ্যা বেশি হলেও অধিকাংশ পলিসের জনসংখ্যা ছিল 5 হাজারের কম। পেলোপনেসীয় যুদ্ধের সময় মাত্র কয়েকটি পলিসের জনসংখ্যা 20 হাজার অতিক্রম করেছিল।
iii. প্রত্যক্ষ শাসন :
পলিসগুলির শাসন পরিচালনায় জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করত। ক্ষুদ্র আয়তনের জন্য পলিসগুলির নাগরিকরা প্রত্যেকে প্রত্যেককেই চিনত। শাসন পরিচালনার জন্য প্রত্যেক নাগরিকই একটি নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হত। তবে মহিলা, ক্রীতদাস বা বিদেশিগণ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শাসন পরিচালনাতে অংশগ্রহণ করতে পারত না। সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষ দেশশাসন করত।
iv. শাসন কাঠামোর বৈচিত্র্য :
পলিসগুলির শাসন কাঠামোর বৈচিত্র্য ছিল। রাজতন্ত্রের প্রচলন না থাকলেও গণতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বিভিন্ন ধরনের শাসন কাঠামো প্রচলিত ছিল।
v. শ্রেণিবিভক্ত সমাজ :
পলিসগুলির সমাজ ছিল শ্রেণিবিভক্ত। নাগরিকরা ছিলেন সুবিধাভোগী শ্রেণি । অনাগরিকরা ছিল সুবিধাহীন শ্রমজীবী মানুষ। বিদেশি ক্রীতদাস, কারিগররা ছিল অনাগরিক। তাই পলিসগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল শোষিত ও অধিকারহীন।
vi. গঠন বিন্যাস :
প্রতিটি পলিসের গঠন কাঠামো ছিল একই রকম।
a. পাহাড়ের শীর্ষে শাসনকেন্দ্র বা অ্যাক্রোপলিসগুলি দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত ছিল।
b. শাসনকেন্দ্রের পাশে মন্দির ও উপাসনাগৃহ ছিল।
c. প্রতিটি পলিসে একটি বাজার থাকত। এই বাজারগুলিকে অ্যাগোরা (Agora) বলা হত।
d. নগরের প্রাচীরের বাইরে গ্রামাঞ্চল ছিল। এটি ‘চোরা’ (Chora) নামে পরিচিত। দরিদ্র জনগণ এখানে বসবাস করত। বিদেশিদের আক্রমণের সময় এই অঞ্চলটি জনশূন্য হয়ে পড়ত।
vii. স্বাতন্ত্র্য :
প্রতিটি পলিসের নিজস্ব পৃথক সরকার, সৈন্যবাহিনী, ক্যালেন্ডার, মানচিত্র, মুদ্রা এবং পৃথক দেবদেবী থাকত। প্রতিটি পলিসের পূজার পদ্ধতিও আলাদা ছিল। প্রতিটি বিষয়ই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত।
vii. অর্থনৈতিক বৈষম্য :
পলিসগুলির অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল দু-ধরনের। বিভিন্ন পলিসের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল বিভিন্ন। যেমন—স্পার্টার অর্থনীতি কৃষি ও মন্দিরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু করিন্থ ও মিলেটাসের অর্থনীতি ছিল শিল্প ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি পলিসের ধনী-দরিদ্র জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র ছিল।