মগধের উত্থানের কারণগুলি লেখো। মগধের সাম্রাজ্যবাদের পরিচয় দাও। |
মগধের
উত্থানের কারণসমূহ :
রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের সংগ্রামে মগধের সাফল্য লাভ এবং সাম্রাজ্যে পরিণত হওয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। মগধের উত্থানের পিছনে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। এই কারণগুলি হল—
i. নিরাপদ
অবস্থান :
মগধ উপদ্রুত উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত থেকে বহুদূরে গাঙ্গেয় উপত্যকাতে অবস্থিত ছিল। এত দূরে বিদেশি
আক্রমণকারীগণের পক্ষে মগধে পৌঁছানো সহজ ছিল না। গ্রিক ও পারসিকদের মতো
শক্তিশালী আক্রমণকারীগণও এত দূরে পৌঁছাতে
পারেনি। এর ফলে মগধবাসীর
জীবনযাত্রা ছিল নিরাপদ এবং মগধের উত্থানের ধারা ছিল অবিচ্ছিন্ন।
ii. অনুকূল
ভৌগোলিক পরিবেশ :
অনুকূল ভৌগোলিক পরিবেশ মগধের উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল। মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ ছিল পাঁচটি পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত। অপর রাজধানী পাটলিপুত্র ছিল জলদুর্গ—গঙ্গা, শোন ও গণ্ডক নদীর
সংগমস্থলে অবস্থিত। মগধের পূর্বদিকে গহন অরণ্য থাকার ফলে শত্রুর কাছে তা দুর্গম ছিল।
iii. সামরিক
কারণ :
মগধের লৌহখনিগুলি ছিল সামরিক শক্তির প্রধান উৎস। কারণ লৌহ দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা। মগধের পূর্বদিকের অরণ্য থেকে হাতি সংগ্রহ করে বিশাল শক্তিশালী রণহস্তী বাহিনী গড়ে তোলা। এই হস্তী বাহিনীর
কারণে গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ী সেনাবাহিনী মগধ আক্রমণ করেনি।
iv. উর্বর
ভূমি :
গঙ্গা ও তার অন্যান্য
শাখানদীগুলির পলি মগধের মৃত্তিকাকে উর্বর ও সুজলা, সুফলা
করে তোলে। এখানে বছরে দু–বার ধানসহ
বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদিত হত। প্রজারা সচ্ছল হওয়াতে মগধের অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধ। ফলে সামরিক বাহিনীর ব্যয় বহন করার সামর্থ্য ছিল।
v. বৈদেশিক
বাণিজ্য :
নদীগুলির ওপর একছত্র আধিপত্য থাকার ফলে মগধ অতি সহজে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখত। গঙ্গানদীর মাধ্যমে জলপথে মগধের বৈদেশিক বাণিজ্য চলত। স্থলপথে মগধের বণিকগণ কাশ্মীর, গান্ধার প্রভৃতি অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করত। এই বৈদেশিক বাণিজ্য
মগধের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তার উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
vi. খনিজ
সম্পদ :
মগধের পূর্বদিকে অবস্থিত লোহা ও তামার খনিগুলি
তার আর্থিক সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল। কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণে লোহা ব্যবহার করে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করেছিল।
vii. সুযোগ্য
নেতৃত্ব :
বিম্বিসার, অজাতশত্রু, মহাপদ্মনন্দ, শিশুনাগ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক প্রমুখ পরাক্রমশালী যোদ্ধা ও তাঁদের সুদক্ষ
মন্ত্রীমণ্ডলের নেতৃত্বে মগধের সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। এইসব বিখ্যাত রাজন্যবর্গের নেতৃত্বে মগধের উত্থান সম্ভব হয়।
viii. মিশ্র
সংস্কৃতি :
আর্য ও অনার্যের সংমিশ্রণে
মগধের উদার ও উন্নত সংস্কৃতি
গড়ে উঠে। আর্য মানসিকতা ও অনার্য বাহুবলের
সংমিশ্রণে মগধের উত্থান দ্রুত হয়।
মূল্যায়ন
:
মগধের উত্থানের কারণগুলির গুরুত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা প্রাকৃতিক আনুকূল্যকে মগধের উত্থানের একমাত্র কারণ বলে দাবি করেছেন। অপরদিকে ড. এ এল
বাসাম ও রোমিলা থাপার
মতো প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মগধের উত্থানের জন্য অর্থনৈতিক কারণগুলিকে বেশি দায়ী করেছেন। যাই হোক না কেন মগধের
উত্থান ঘটেছিল একটি দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের ফলে, একদিনে বা কোনো নির্দিষ্ট
সময়ে নয় ।
মগধের
সাম্রাজ্যবাদ :
মগধের
শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলেই মগধ বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। হর্যঙ্ক, শিশুনাগ, নন্দ ও মৌর্য বংশের
সম্রাটদের ধারাবাহিক সাম্রাজ্যবাদী নীতির ফলেই ষোড়শ মহাজনপদের বিভিন্ন রাজ্যগুলি গ্রাস করে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থশতকে মগধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
i. বিম্বিসার
:
মগধের সাম্রাজ্যবাদী নীতির সূচনা করেন হর্ষঙ্ক বংশের রাজা বিম্বিসার। তিনি অঙ্গ রাজ্যটি জয়ের মধ্য দিয়ে মগধের সাম্রাজ্য বিস্তারের সূচনা করেন। এ ছাড়া তিনি
কৌশলদেবীকে বিবাহ করে কাশী রাজ্যটি লাভ করেন।
ii. অজাতশত্রু
:
অজাতশত্রু পিতা বিম্বিসারের পথ অনুসরণ করে
দীর্ঘ ষোলো বছর ধরে যুদ্ধ করে চেতককে পরাজিত করে বৃজি বা বৈশালী রাজ্যটি
জয় করেন।
iii. উদয়ী
:
অজাতশত্রুর পুত্র উদয়ী বা উদয়ভদ্র মগধের
সিংহাসনে বসে অবন্তী রাজ্যটিকে পরাজিত করে মগধের শক্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি রাজগৃহে রাজধানী স্থাপন করেন।
iv. শিশুনাগ
:
শিশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিশুনাগ বস ও কোশল
রাজ্য দুটি জয় করে মগধের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।
v. মহাপদ্মনন্দ
:
নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দ পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন। তিনি পাঞ্চাল, কলিঙ্গ, অস্মক, কুরু, সুরসেন, মিথিলা প্রভৃতি রাজ্য জয় করে সমগ্র উত্তর ভারতে মগধের আধিপত্য স্থাপন করেন। এইজন্য ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়
তাঁকে ‘উত্তর ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট‘ বলেছেন।
vi. চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্য :
নন্দবংশ উচ্ছেদ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের সিংহাসনে বসেন। তিনি মগধের রাজ্যসীমা দক্ষিণ ভারতের মহীশূর ও তামিলনাড়ুর কিছু
অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। পশ্চিম ভারতের মালব, সৌরাষ্ট্র, কোঙ্কন জয় করেন। উত্তর–পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন। গ্রিক সেনাপতি সেলুকাসকে পরাজিত করে সিন্ধু, পাঞ্চাল, কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও মকরান লাভ
করেন। এই জন্য ঐতিহাসিক
হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি তাঁকে ‘ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট‘ বলেছেন।
vii. অশোক
:
সম্রাট অশোক কলিঙ্গ জয় করে যুদ্ধনীতি ত্যাগ করেন সত্য। তবে শান্তি ও মৈত্রীর বাণী
দিয়ে বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করেন ।