ভূমিকা
একুশ শতকে বিজ্ঞানের আলোকিত অগ্রগতি যেমন মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ, ভারসাম্যহীন উন্নয়ন নিয়ে এসেছে আশঙ্কার কালো মেঘ। বিশ্ব উন্নায়ন, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Global Warming এরকমই একটি আতঙ্কের নাম।
বিশ্ব উষ্ণায়ন কী
আপাতভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন কথাটির অর্থ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেলজয়ী সুইডিশ বিজ্ঞানী আরথেনিয়াস বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাঁর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ২০৩০ খিস্টাব্দের মধ্যে উষ্ণতা বৃদ্ধির এই হার হবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল হবে মানবসভ্যতার সর্বনাশ।
বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গ্রিনহাউস গ্যাস
বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসসমূহ যেমন- কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কোরোফ্লুরোকার্বন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদির বৃদ্ধি তাপীয় ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। শিল্পবিপ্লবের আগে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ছিল ২৮০ পিপিএম, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮২ পিপিএম। একইভাবে বছরে গড়ে ৪৪০-৬০০ মিলিয়ন টন মিথেন বায়ুমণ্ডলে এসে মিশছে। গ্রিনহাউস এফেক্টে এই মিথেনের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ।
মানুষের দায়িত্ব
পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা গ্রিনহাউস এফেক্ট তৈরিতে মানুষেরই ভূমিকা প্রধানতম। নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করা, কাঠ এবং জীবাশ্মকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা, সিমেন্ট শিল্পের প্রসার ইত্যাদি বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধি ঘটায়। এ ছাড়া সার শিল্প, অ্যালুমিনিয়াম শিল্প, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর শিল্প ইত্যাদি বাতাসে নানারকম গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে।
প্রভাব
গ্রিনহাউস এফেক্ট এবং বিশ্ব উন্নায়নের ফলে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ গত দুশো বছরে উন্নতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এই অবস্থা বজায় থেকেছে পরবর্তী সময়েও। খরা, বন্যা, তুষারঝড় ইত্যাদি নানান বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এক মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৬২ টি টর্নেডো হয়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। গত ৩০ বছরে সুমেরুর বরফ গলেছে ৩৮,০০০ বর্গকিমি। এর ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে চলেছে বর্তমানে প্রতিবছর ৩.১ মিলিমিটার হারে। ফলে এক বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী ভূখণ্ড চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছে। ডেঙ্গু, এনকেফেলাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি অসুখের প্রাদুর্ভাব ঘটছে- এমনটাই জানিয়েছেন হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের চিকিৎসকরা। জীবকুলের অস্তিত্বও বিপন্ন হচ্ছে। বরফ গলে যাওয়ায় পেঙ্গুইন, মেরুভল্লুক ইত্যাদি প্রাণীরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।
প্রতিরোধের প্রয়াস
গ্রিনহাউস গ্যাস বেরোনো বন্ধ করতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেরোতে বসেছিল বসুন্ধরা শীর্ষসম্মেলন। পরবর্তীকালে ২০০২-এ জোহেনসবার্গে, ২০০৫-এ জাপানের কিয়োটো শহরে এবং ২০০৭-এ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে একই উদ্দেশ্যে সম্মেলন হয়। কিন্তু এই বিপর্যয়ের জন্য যে উন্নত দেশগুলি প্রধানত দায়ী তাদের অসহযোগিতায় কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তাই আশঙ্কার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে আছে একুশ শতকের বিজ্ঞানপ্রদীপ্ত মানবসভ্যতা।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা